ঢাকা   সোমবার ০২ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কোরবানির মৌসুমে তাকওয়া, ত্যাগ আর কর্মসংস্থানের উৎসব

কোরবানির মৌসুমে তাকওয়া, ত্যাগ আর কর্মসংস্থানের উৎসব

কোরবানি শুধু একটি ধর্মীয় ইবাদত নয়, বরং তা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, আত্মসমর্পণ ও মানবিক মূল্যবোধের অনুপম প্রতীক। ইতিহাসে যার সূচনা হয়েছিল হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে, যখন তিনি আল্লাহর আদেশে নিজ সন্তান ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানির জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করে আজও মুসলিম বিশ্ব পালন করে এই ত্যাগের উৎসব।

কোরআন বলেছে, কোরবানির পশুর মাংস কিংবা রক্ত নয়, বরং আল্লাহর কাছে পৌঁছে মানুষের তাকওয়া (সুরা হজ, আয়াত ৩৭)। অর্থাৎ এই ইবাদত মূলত নিজের লোভ, ভোগ-লালসা ও আত্মকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে একটি আত্মিক যুদ্ধ। অনেকেই ভুল করে ভাবেন, এতে অর্থের অপচয় হয়। অথচ বাস্তবতা হলো, কোরবানির মাধ্যমে সমাজে সৃষ্টি হয় সাম্য, সহমর্মিতা ও বিশাল মানবিক কল্যাণচক্র।

বাংলাদেশে প্রতিবছর কোরবানির মৌসুমে কোটি কোটি টাকার পশু কেনাবেচা হয়। এই পশুর মাংস বিতরণ হয় দরিদ্র, এতিম, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের মাঝে, যারা অনেক সময় গোশতের স্বাদও পান না। কোরবানি তাই শুধু এক দিনের ধর্মীয় অনুশীলন নয়, বরং এটি সমাজজুড়ে খাদ্য বণ্টনের কার্যকর একটি পদ্ধতি।

এছাড়া কোরবানিকে ঘিরে গড়ে ওঠে অস্থায়ী কর্মসংস্থানের এক বিশাল ক্ষেত্র। পশু পালনকারী কৃষক, কসাই, পরিবহন শ্রমিক, হাট ব্যবস্থাপক, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শ্রমিক—সবাই এই সময়ে রোজগারের সুযোগ পান। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কোরবানির মৌসুমে অন্তত পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষ সাময়িক কর্মসংস্থানের সুবিধা পান। রিকশাচালক থেকে শুরু করে দিনমজুর পর্যন্ত অনেকেই আয় করেন এই উৎসব কেন্দ্রিক কাজ থেকে।

কোরবানির পশুর চামড়া দেশের রপ্তানি খাতের একটি বড় অংশ। বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, প্রতিবছর এখান থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। ফলে কোরবানি অর্থনৈতিকভাবেও দেশের জন্য সুফল বয়ে আনে।

যাঁরা পশুপ্রেমের কথা বলে কোরবানির বিরোধিতা করেন, তাঁরা হয়তো ভুলে যান যে সারা বছরই শিল্পায়িত খাদ্য ব্যবস্থায় লাখ লাখ পশু জবাই হয়। অথচ সেখানে মানবতা বা নিষ্ঠুরতার প্রসঙ্গ কেউ তোলে না। মুসলমানরা যখন পবিত্রতা, দোয়া আর সম্মানের সাথে আল্লাহর নামে পশু জবাই করেন, তখনই নাকি তা হয়ে যায় ‘বর্বরতা’! বাস্তবে এটি পশুপ্রেম নয়, বরং এক ধরনের ধর্মবিরোধী বিদ্বেষ।

‘ইবাদত নয়, সেই টাকায় মানুষকে সাহায্য করুন’—এই কথাটি যেন এক প্রকার ছলনা। ইসলাম কখনোই ইবাদত ও মানবতার মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেনি। বরং প্রকৃত ইবাদতের মাধ্যমেই মানবতার পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটে। কোরবানি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

তাই কোরবানিকে কেবল পশু জবাইয়ের উৎসব হিসেবে নয়, বরং তাকওয়া, ত্যাগ, মানবিক সহমর্মিতা এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এক শক্তিশালী উপাদান হিসেবে দেখা উচিত। কারণ কোরবানি মানেই—ইমানের পরীক্ষা, আত্মশুদ্ধি ও মানবতার বিজয়।