
হজ এমন এক ইবাদত যা আল্লাহর প্রতি অগাধ প্রেম, আত্মত্যাগ ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মুসলিম জাতিকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও নিষ্ঠার যে আবেগ জাগায়, তা সব ধরনের সামাজিক, শ্রেণিগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে অতিক্রম করে। ধনী-দরিদ্র, শাসক-প্রজা, গুনাহগার ও আল্লাহপ্রেমিক—সবাই সেখানে এক পোশাকে, এক ময়দানে, এক কাবাঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়; যেন আল্লাহর প্রেমে ডুবে যাওয়া এক বিশাল কাফেলা।
এই সফর কেবল আনুষ্ঠানিক ইবাদতের নয়—এটি সহনশীলতা, সহানুভূতি, ক্ষমা ও বিনয়ের এক মহাসাধনার ময়দান। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘অন্যকে ক্ষমা করলে আল্লাহ মর্যাদা বাড়িয়ে দেন, আর যে বিনীত হয় আল্লাহ তাকে উচ্চে তুলে ধরেন।’ (সহিহ মুসলিম)। হজের মাধ্যমে আল্লাহর প্রেমিকরা নিজেদের ভেঙে গড়ে তোলে—তাদের আত্মা আল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত হয়, আর দেহ সমবেত হয় বিশ্ব মুসলিমের মিলনমেলায়।
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো মক্কায়—তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারি।’ (আলে ইমরান : ৯৬)। হজ সেই বরকতময় ঘরের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের মাধ্যম। কাবা শুধু পাথরের দেয়াল নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের কেন্দ্র, আত্মিক জাগরণের কেন্দ্রবিন্দু।
ফেরেশতাদের হাত ধরে যাত্রা শুরু করা এই ঘর আদম (আ.) থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসুলের হজ সফরের অংশ। আজও কোটি কোটি মানুষ এখানে এসে আত্মশুদ্ধির অনুপম সুযোগ পায়। আল্লাহ হজযাত্রীদের মাধ্যমে উম্মতের জন্য ক্ষমা ও রহমতের দ্বার খুলে দেন। হজ শেষে তারা ফেরে এক নতুন মানুষ হয়ে—আত্মপ্রেম থেকে আল্লাহপ্রেমে উত্তীর্ণ হয়ে।
কাবাঘরে প্রতিবছর প্রেম ও আত্মবিসর্জনের পাগলপারা মানুষদের সম্মিলন ঘটে। এই সম্মেলন মুসলিম উম্মাহকে শেখায়—আত্মত্যাগ, সহানুভূতি ও পরস্পরের প্রতি সহনশীলতা কিভাবে মানবতার ভিত্তি গড়ে। সমাজে ইনসাফ, ন্যায়, সৌহার্দ্য ও ঐক্যের আলো ছড়িয়ে দিতে পারে সেই মুসলিম, যার অন্তর আল্লাহর ভালোবাসায় পূর্ণ।
হজ কেবল অতীতের ইতিহাস নয়, এটি বর্তমানের অনুপ্রেরণা এবং ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা। হজের শিক্ষা যদি মুসলিমরা বাস্তব জীবনে অনুসরণ করে—পারস্পরিক ত্যাগ, শ্রদ্ধা ও ঐক্যের ভিত্তিতে সমাজ গড়ে তোলে, তবে জীবনের সকল জটিলতা সহজ হবে, আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ লাভ হবে এবং মুসলিম উম্মাহ বিশ্বদরবারে আদর্শ জাতিতে পরিণত হবে।
মহানবী (সা.) আরাফার ময়দানে যে হৃদয়স্পর্শী দোয়া করেছিলেন, তাতে ফুটে উঠেছে মানবজাতির প্রতি হজের গভীর বার্তা। তিনি আল্লাহর দরবারে নিজেকে এক দরিদ্র, লাঞ্ছিত ও ক্ষমাপ্রার্থী বান্দা হিসেবে পেশ করে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আমার এই প্রার্থনাকে তুমি ব্যর্থ কোরো না…’। এই দোয়ার প্রতিটি শব্দে ছিল প্রেম, বিনয় ও আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত প্রকাশ।
শেষ কথায় বলা যায়, হজ হলো আল্লাহর প্রেমে আত্মবিসর্জনের মহাসমর; যেখানে কেবল শরীর নয়, আত্মাও সেজে ওঠে ইবাদতের পূর্ণতায়। এই প্রেমের শিক্ষা যেন আমরা জীবনের প্রতিটি স্তরে ধারণ করি—এ কামনা সর্বত্র। আল্লাহ সবাইকে হজের প্রকৃত শিক্ষা ও উপলব্ধি দান করুন। আমিন।