
আগামী শুক্রবার আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকে বসছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ওই শীর্ষ বৈঠকে ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের পথ খুঁজে পেতে চেষ্টা করবেন। এত জায়গা থাকতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কেন নিজেদের সুদূর উত্তরাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য আলাস্কাকে বেছে নিলেন, এ নিয়ে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে।
মজার বিষয় হলো, পাহাড় আর বরফে ঢাকা আলাস্কা একসময় রাশিয়ার অংশ ছিল। ১৮৬৭ সালে রাশিয়া অঞ্চলটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। অঙ্গরাজ্যটির পশ্চিম প্রান্ত থেকে রাশিয়ার পূর্বতম অংশ খুব বেশি দূরে নয়, মাঝে শুধু বেরিং প্রণালি।
যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হওয়ার পর দেড় শ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আলাস্কায় রাশিয়ার প্রভাব এখনো বিদ্যমান। রাশিয়া থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে আলাস্কার অবস্থান।
তবে শুধু ইতিহাসের প্রতি সম্মান দেখাতে ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকের ভেন্যু হিসেবে আলাস্কাকে বেছে নেওয়া হয়নি; বরং এখানে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের ব্যাপার রয়েছে। এই বৈঠকের ফলাফল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের রূপরেখার ইঙ্গিতও হয়তো পাওয়া যাবে।
কৃতিত্বের ভাগ অন্য কাউকে না দেওয়া
আন্তর্জাতিক নানা বিরোধনিষ্পত্তির আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানকে। গাজা যুদ্ধ অবসানের পথ খুঁজে পেতে দুজনই প্রভাবশালী ভূমিকায় রয়েছেন। স্পষ্টতই ট্রাম্প তাঁদের সঙ্গে মনোযোগের কেন্দ্র ভাগাভাগি করতে চাইবেন না। তাঁদের অংশগ্রহণ অনিবার্যভাবে শীর্ষ সম্মেলনের মনোভাব ও অগ্রাধিকার পরিবর্তন করে দিত।
ভৌগোলিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দূরবর্তী অঙ্গরাজ্যটি ট্রাম্পের বেছে নেওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে, তাঁর ডেমোক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বীদের পাশাপাশি ন্যাটো জোটের মিত্রদের থেকেও দূরত্ব বজায় রাখা। হয়তো ট্রাম্প ভেবে নিয়েছেন, ন্যাটো জোটের অন্য মিত্ররা ইউক্রেনের স্বার্থে কাজ করে একটি চুক্তির পথে সম্ভাব্য কোনো অগ্রগতি বিঘ্নিত করতে চাইবে।
ন্যাটো জোটের মিত্রদের কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, ট্রাম্প হয়তো একপক্ষীয়ভাবে ইউক্রেনের স্বার্থকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে পারেন।
জনবিরল আলাস্কা ও পুতিনের আইনি জটিলতা
আলাস্কায় জনঘনত্ব অনেক কম। জনসংখ্যা কম থাকায় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর জন্য সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলা বা পরিকল্পিত উসকানিমূলক ঘটনার ঝুঁকি কমানো অপেক্ষাকৃত সহজ। সেই সঙ্গে পুতিনের পক্ষে এখানে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এড়ানো সম্ভব হবে।
পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে। এ কারণে পুতিন আইসিসির সদস্যদেশগুলোতে গেলে তারা পুতিনকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবে। স্বাভাবিকভাবেই এ বিষয়টি মাথায় রেখে ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের স্থান ঠিক করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্যরাষ্ট্র নয়।
আলাস্কার ভৌগোলিক অবস্থান
আলাস্কার ভৌগোলিক অবস্থানও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র সত্যিকারের আর্কটিক অঞ্চল আলাস্কা। ট্রাম্প প্রশাসন আলাস্কাকে ব্যবহার করে কানাডা ও গ্রিনল্যান্ডকে আরও কঠোরভাবে মার্কিন প্রভাববলয়ের মধ্যে আনার জন্য চাপ প্রয়োগে ব্যবহার করছে। এ কারণে অঙ্গরাজ্যটি দিন দিন উত্তরাঞ্চলের কৌশলগত মঞ্চে পরিণত হচ্ছে।
এখানে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক স্বার্থ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বেরিং প্রণালি দিয়ে আংশিকভাবে যাওয়া উত্তর সমুদ্রপথের উন্নয়ন থেকে শুরু করে সাগরের তলদেশে থাকা তেল ও গ্যাসের উৎস খোঁজা পর্যন্ত উভয় দেশের স্বার্থ এখানে একে অপরের সঙ্গে জড়িত।
দুই দেশের এই পারস্পরিক স্বার্থের উৎকৃষ্ট উদাহরণ লোমোনোসভ রিজ। আর্কটিক মহাসাগরে পানির নিচে অবস্থিত এই পর্বতমালাকে রাশিয়া নিজেদের ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্প্রসারণ হিসেবে দাবি করে। যৌথ আর্কটিক প্রকল্প এই অঞ্চলকে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধিশালী অঞ্চলে পরিণত করতে পারে। অবশ্য ভিন্ন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে এটি আবার হয়ে উঠতে পারে পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা ও আকাশ প্রতিরক্ষা মহড়ার মঞ্চ।
আলাস্কার ইতিহাস
ভূখণ্ডের মালিকানা অপরিবর্তনীয় থাকার কোনো ঐতিহাসিক বা ভৌগোলিক নিয়ম নেই; বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণে ভূখণ্ডের মালিকানা সদা পরিবর্তনশীল। ঐতিহাসিক সব মুহূর্তে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের চুক্তির মাধ্যমে ভূমির মালিকানা বদলে যায়, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আলাস্কা।
দিয়েছেন।
ট্রাম্প-পুতিন বৈঠক ঘিরে যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে, সেটিও ভূমির মালিকানার পরিবর্তন ঘিরে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজেই এই আলোচনা উসকে দিয়েছেন। গত শুক্রবার তিনি পুতিনের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের সময় এবং স্থানের নাম জানান।
সেদিনই বৈঠকের বিষয়ে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘ইউক্রেন ও রাশিয়া—উভয়ের মঙ্গলের জন্য কিছু এলাকা অদলবদল করা হবে।’
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে পদক্ষেপ নিতে রাশিয়ার মূল দাবিগুলোর মধে৵ অন্যতম এই ভূমি অদলবদল। পুতিনের দাবি, যুদ্ধে রাশিয়া ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল দখলে নিয়েছে, কিয়েভকে সেগুলোর মালিকানা মস্কোর কাছে ছেড়ে দিতে হবে।
পশ্চিমা বিশ্লেষকেরাও এমন একটি চুক্তিকে মস্কোর কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে অভিহিত করেছেন।
‘কিছু অঞ্চল হাতবদলের’ যে কথা ট্রাম্প বলেছেন, তার কড়া সমালোচনা করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। গত শনিবার এক ভাষণে তিনি বলেছেন, নিজেদের ভূখণ্ড-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করে কোনো পদক্ষেপ নেবে না ইউক্রেন। ‘দখলদারদের’ নিজেদের ভূখণ্ড ‘উপহার’ হিসেবে দেবেন না ইউক্রেনীয়রা।
জেলেনস্কি ১৫ আগস্টের ওই বৈঠকে থাকবেন কি না, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।