
পুরান ঢাকার গলিঘুঁজির মধ্য দিয়ে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে এক ছোট্ট দোকান—যেখানে ভিড় লেগেই থাকে। নাম ‘ইউসুফ কনফেকশনারী’, তবে স্থানীয়দের কাছে এটি ‘ইউসুফ বেকারি’ নামেই পরিচিত। ৮৬ বছর ধরে টিকে থাকা এই বেকারি শুধু খাবারের স্বাদেই নয়, ঐতিহ্যেও মুগ্ধ করে পুরান ঢাকাবাসীসহ ঢাকার নানা প্রান্ত থেকে আসা ভোজনরসিকদের।
ইতিহাসে গন্ধ লেগে থাকা এই দোকান
এই দোকানের সূচনা ১৯৩৯ সালে, মোহাম্মদ ইউসুফের হাত ধরে রায়সাহেব বাজারে। শৈশবে নানা আবদুল ব্যাপারীর কাছ থেকেই বেকারি ব্যবসার হাতেখড়ি হয় তাঁর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বেড়ে চলে আসে জনসন রোডে। ১৯৫৮ সাল থেকে এখানেই চালু আছে বেকারিটির মূল শাখা। বর্তমানে ইউসুফের ১১ পুত্রের উত্তরসূরিরাই চালাচ্ছেন ১২টি শাখা, যেগুলো ছড়িয়ে রয়েছে গুলশান, রমনা, রামপুরা, ধানমন্ডি, ধোলাইখালসহ বিভিন্ন এলাকায়।
দোকানের প্রতিটি শাখায় একই স্বাদ
সব শাখার খাবার প্রস্তুত হয় পুরান ঢাকার জজকোর্টের পেছনে অবস্থিত একটি কারখানায়। এখানেই তৈরি হয় বিস্কুট, কেক, রুটি, প্যাটিস, রোলসহ নানান মুখরোচক খাবার। খাবারের গুণগত মান ধরে রাখতে প্রতিটি শাখায় একরকম পণ্য সরবরাহ করা হয়। দোকানের বিশেষ আকর্ষণ চানাচুর—যা ক্রেতার পছন্দ অনুযায়ী মশলা ও উপকরণ মিশিয়ে তৎক্ষণাৎ তৈরি করে দেওয়া হয়।
বিশেষ দিনে বিশেষ স্বাদ
শবে বরাত ও রমজানে এখানে মেলে মাছ আকৃতির রুটি, সুজি ও বুটের হালুয়া, সুতি কাবাব, জালি কাবাব, হালিম, জিলাপি, গ্রিলড চিকেনসহ নানা আয়োজন। এসব খাবারের স্বাদ আর গন্ধ এতটাই জনপ্রিয় যে অর্ডার দিয়েই সংগ্রহ করতে হয়।
খাবারের দাম ও বৈচিত্র্য
চানাচুরের কেজি ৩০০ টাকা, বিস্কুট ৩৮০-৪০০ টাকা, প্যাটিস ৪০-৬০ টাকা, কেক ১৯০-৩০০ টাকায় মেলে এখানে। আরও আছে বিখ্যাত ‘ঘোড়ার ডিম’ নামের এক মজার ক্যান্ডি, যার দাম ৩০ টাকা মাত্র। পাউরুটি, চিপস, পরোটা—সবই মেলে হাতের নাগালে।
ইউসুফ বেকারির প্রতি মানুষের টান
ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায় ইউসুফ বেকারির প্রতি ভালোবাসা কত গভীর। কেউ কেক নিতে আসেন, কেউ চানাচুর, কেউবা শুধু পুরান ঢাকার স্বাদ নিতে। দোকানে ৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেই বোঝা যায়, এই দোকান কেবল ব্যবসা নয়—এটা ঢাকার খাদ্যসংস্কৃতির একটি জীবন্ত নিদর্শন।
৮৬ বছর ধরে ঐতিহ্য আর স্বাদের গাঁথুনিতে গড়ে ওঠা ইউসুফ বেকারির গল্প যেন পুরান ঢাকারই প্রতিচ্ছবি। সেখান থেকে বিদায় নিতে নিতে মনে হয়—এ শুধু এক দোকান নয়, এটা একটা সময়ের গন্ধ, ঢাকার আত্মার অংশ।