
কোরআনের আলোকে এমন এক শিক্ষামূলক সফরের বিবরণ পাওয়া যায়, যা আল্লাহর জ্ঞানের বিশালতা ও বিনয় শেখার অপূর্ব দৃষ্টান্ত। নবী মুসা (আ.) একদিন বনি ইসরাঈলের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন, হঠাৎ কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জ্ঞানী কে? স্বাভাবিকভাবে তিনি নিজেকেই উল্লেখ করেন, কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁকে জানান—তাঁর চেয়েও জ্ঞানী একজন ব্যক্তি আছেন। এই উত্তরের পর থেকেই শুরু হয় জ্ঞান অর্জনের এক ঐতিহাসিক অভিযান।
আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.)-কে বলেন, একটি থলিতে মাছ নিয়ে দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে যাও। যেখানে মাছটি হারিয়ে যাবে, সেখানেই সেই জ্ঞানী ব্যক্তিকে পাবে। মুসা (আ.) তাঁর সঙ্গী যুবক ইউশা ইবনে নুনকে সঙ্গে নিয়ে সফরে রওনা দেন। পথের একটি স্থানে বিশ্রামের সময় মাছটি আশ্চর্যজনকভাবে জীবিত হয়ে পানিতে চলে যায়। পরে ভুল স্মরণে থাকা ঘটনাটি মনে পড়তেই মুসা (আ.) বুঝতে পারেন—ঠিক ওই জায়গাটিই তাঁর কাঙ্ক্ষিত স্থান।
তাঁরা ফিরে গিয়ে সাক্ষাৎ পান এক মহান আল্লাহপ্রদত্ত জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির—তিনি ছিলেন খিজির (আ.)। মুসা (আ.) তাঁর সঙ্গে সফর করে ইলম অর্জনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। খিজির (আ.) বলেন, এই জ্ঞান সহ্য করতে ধৈর্য লাগবে, যা হয়তো মুসা (আ.) করতে পারবেন না। কিন্তু মুসা (আ.) ধৈর্যের প্রতিশ্রুতি দেন।
এরপর শুরু হয় তাদের একত্রে পথচলা। পথে খিজির (আ.) কয়েকটি কাজ করেন, যেগুলোর তাৎক্ষণিক ব্যাখ্যা না পেয়ে মুসা (আ.) প্রশ্ন করেন। প্রথমে একটি নৌকা ছিদ্র করেন, পরবর্তীতে একটি বালককে হত্যা করেন এবং শেষে এক স্বার্থপর জনপদের লোকদের অতিথেয়তা না পাওয়ার পরও তাদের একটি ভাঙা প্রাচীর মেরামত করেন। প্রতিবারই মুসা (আ.) প্রশ্ন করেন, এবং প্রতিবার খিজির (আ.) তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন—এই সফরে ধৈর্য ধরার কথা বলা হয়েছিল।
শেষমেশ, খিজির (আ.) তাঁকে তিনটি ঘটনার ব্যাখ্যা দেন।
১. ছিদ্র করা নৌকাটি ছিল দরিদ্র মাঝিদের, যাদের নৌকা ছিনিয়ে নিতে একটি অত্যাচারী বাদশাহ আসছিল।
২. হত্যা করা বালকটি ভবিষ্যতে ঈমানদার মা-বাবার জন্য বিপদ হয়ে উঠত, তাই আল্লাহ তাকে সরিয়ে আরও উত্তম সন্তান দেওয়ার ইচ্ছা করেছিলেন।
৩. প্রাচীরের নিচে ছিল দুই পিতৃহীন বালকের গুপ্তধন, যাদের বাবা ছিলেন সৎ। প্রাচীর ঠিক করার মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করা হয়।
এই শিক্ষামূলক সফরের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়,
জ্ঞান অর্জনে সময় ও ধৈর্য অপরিহার্য।
আল্লাহর পরিকল্পনা মানুষের চোখে রহস্যময় হলেও, তা সর্বোত্তম কল্যাণে পূর্ণ।
সুশাসক, আমানতদার ও আদর্শ সন্তান—এই তিন উপাদান একটি সমাজকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, "যদি মুসা (আ.) আরও কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরতেন, তবে আমরা আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে পারতাম।" (বুখারি, হাদিস : ১২২)
এই কোরআনিক কাহিনি আমাদের শেখায়—জ্ঞানই আলো, আর সেই আলোর সন্ধানে থাকা একজন মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ।