ঢাকা   সোমবার ১৯ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

রমনার বুকে ছায়াময় ভালোবাসা—হেয়ার রোড যেন শহরের এক গহিন কবিতা

জাতীয়

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ১৮ মে ২০২৫

রমনার বুকে ছায়াময় ভালোবাসা—হেয়ার রোড যেন শহরের এক গহিন কবিতা

ঢাকার প্রাণকেন্দ্র রমনা শুধু একটি পার্ক নয়, এটি শহরের এক অনন্য নিঃশ্বাস। সেই রমনার পাশ ঘেঁষেই বয়ে গেছে একটি চিরমায়াময় রাস্তা—হেয়ার রোড। ঢাকার অন্যতম সুন্দর এই সড়ক একদিকে শতবর্ষী বৃক্ষের ছায়া, অন্যদিকে রমনার নিসর্গঘেরা নিঃশব্দতা নিয়ে যেন নাগরিক ব্যস্ততার মাঝেও প্রশান্তির কাব্য রচনা করে। যে কেউ এখানে সকাল, দুপুর কিংবা সন্ধ্যায় হাঁটলে ক্লান্তির বদলে পাবেন এক নির্মল অনুভব।

সম্প্রতি এক সকালে হেয়ার রোডে দেখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনের সক্রিয় মুখ সুস্মিতা রায়ের সঙ্গে। সেগুনবাগিচার বাসিন্দা সুস্মিতা বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে রমনার প্রেমে পড়েছিলাম। এখনো যখনই সময় পাই, ছুটে আসি। বিশেষ করে হেয়ার রোড আমাকে মায়ায় জড়িয়ে রেখেছে। যদিও এখন আর পুরো রাস্তাজুড়ে হেঁটে যাওয়া যায় না, তবুও যতটুকু পারি হেঁটে নিই।”

ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড় থেকে হেঁটে গেলে মিন্টো রোডমুখী সোজা পথে একটি গোলচত্বর এসে পড়ে। সেখান থেকে ডানে বাঁক নিলে ধনুকাকৃতি এক মহিরুহশোভিত রাস্তা চোখে পড়ে—এটাই হেয়ার রোড। রমনার অরুণোদয় থেকে উত্তরায়ণ ফটক পর্যন্ত বিস্তৃত পথটি শুধু চলাচলের রাস্তা নয়, এটি এক সাংস্কৃতিক সংযোগ-রেখা; যেখান থেকে ঢাকার প্রশাসনিক ও নাগরিক প্রাণকেন্দ্রগুলো ছোঁয়া যায় সহজেই।

এই রোডের সবচেয়ে চমকপ্রদ দিকটি হলো রাস্তার দু’পাশজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিরল পাদাউক বৃক্ষের সারি। উচ্চতায় প্রায় ৩০-৪০ মিটার দীর্ঘ এই বৃক্ষগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম Pterocarpus indicus, ইংরেজি নাম বার্মিজ রোজউড। ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় পাদাউক বীথি এটি। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, শত বছর আগে বৃক্ষপ্রেমী ও কিউ গার্ডেনের কর্মী রবার্ট লুইস প্রাউডলক এগুলো মিয়ানমার থেকে এনে রমনায় রোপণ করেন। নগর-পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাঁর এই উদ্যোগ ছিল ঢাকাকে উদ্যান-নগরী হিসেবে গড়ে তোলার এক চমৎকার নিদর্শন।

পরিবেশবিদ মোকারম হোসেন জানান, “পাদাউক আমাদের জীববৈচিত্র্য ও নগর প্রকৃতির সঙ্গে মানানসই। শুধু আলংকারিক নয়, এটি আমাদের প্রাণ-প্রতিবেশের অংশ। হেয়ার রোডে বর্তমানে ৭০-৮০টি পাদাউক বৃক্ষ রয়েছে, যা এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে।”

এই বৃক্ষের আরেক বৈশিষ্ট্য—পাদাউক এক দিনের ফুল ফোটায়। দিনের শুরুতে প্রস্ফুটিত হয়ে সৌরভ বিলিয়ে সন্ধ্যার আগেই ঝরে পড়ে, যেন প্রকৃতির এক নিঃশব্দ বিস্ময়।

এই সড়কের নামকরণ হয়েছে সমাজসেবী ডেভিড হেয়ারের নামে, যিনি স্কটল্যান্ড থেকে এসে উপার্জিত অর্থ এ দেশের দুঃস্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছিলেন। তাঁর স্মৃতিকে অমর করতেই এই সড়কের নাম হয় "হেয়ার রোড"।

হেয়ার রোডে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, শহরের কোলাহল পেরিয়ে ঢুকে পড়েছি এক গহিন প্রকৃতির কোণে—যেখানে গাছের পাতায় ঝরে পড়ে দিনের ক্লান্তি, মানুষের পদচিহ্নে মিশে যায় স্মৃতির ধ্বনি। এই রাস্তাটি যেন একটি জীবন্ত কবিতা, যা প্রতিদিনই নতুনভাবে লেখা হচ্ছে শহরের বুকজুড়ে।