ঢাকা   রোববার ২০ জুলাই ২০২৫, ৫ শ্রাবণ ১৪৩২

যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম কিনতে চুক্তি আজ, লক্ষ্য বাণিজ্যঘাটতি হ্রাস

যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম কিনতে চুক্তি আজ, লক্ষ্য বাণিজ্যঘাটতি হ্রাস

বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ব্যবধান কমে আসুক—বাংলাদেশ সরকারও তা চায়। কীভাবে এ ব্যবধান কমিয়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি বাড়ানো যায়, সে জন্যই মার্কিন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তার অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকারিভাবে গম আমদানি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এত দিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আসত সাহায্য হিসেবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানির জন্য উভয় দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হবে আজ রোববার। বাংলাদেশের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে খাদ্য অধিদপ্তর এবং ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ) পক্ষে ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েটসের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা সমঝোতা স্মারকে সই করবেন।

সূত্রগুলো জানায়, সরকার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি তিন লাখ টন গম আমদানি করবে। প্রতি টনে ২০ থেকে ২৫ মার্কিন ডলার বেশি দিয়ে হলেও এ গম যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা হবে। তবে এ দফায় তিন লাখ টনের এমওইউ হচ্ছে না, হচ্ছে ২ লাখ ২০ টনের। প্রতি লটে বা কনসাইনমেন্টে ১ লাখ ১০ হাজার টন করে গম আসবে।

এবিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, তিন উদ্দেশ্য সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠকগুলো চলছে। উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি, বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠন (অ্যাডভোকেসি) এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমানো।

সপ্তাহব্যাপী চলা বৈঠকগুলোর মধ্যে শেষটি হতে যাচ্ছে ২২ জুলাই, মঙ্গলবার। এটি হবে আমেরিকান অ্যাপারেলস অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের (এএএফএ) সঙ্গে। বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ও জুতা আমদানিকারক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে এই সংস্থা।

যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি শেভরন, এক্সিলারেট এনার্জি এবং ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েটস, ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল (ইউএসএসইসি) ও ইউএস কটন অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে এরই মধ্যে অনলাইনে বৈঠক করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা।

বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক হার কমিয়ে আনার ব্যাপারে দুই দফা আলোচনা চললেও এখন পর্যন্ত কোনো ফয়সালা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৮ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো চিঠির ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ১ আগস্ট নতুন হার কার্যকর হলে বিদ্যমান ১৫ শতাংশের সঙ্গে নতুন হার যোগ হয়ে মোট শুল্কহার দাঁড়াবে ৫০ শতাংশে।

এ হার কমিয়ে আনার ব্যাপারে আরেক দফা আলোচনা করতে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি দল যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, তাঁরা যাচ্ছেন। তবে তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ গতকাল শনিবার পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, পাল্টা শুল্কের হার কমিয়ে আনার ব্যাপারে তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনার তারিখের জন্য আজ রোববার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ই-মেইল পাঠিয়ে অনুরোধ করা হবে।

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ব্যবধান বরাবরই বাংলাদেশের পক্ষে, যা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অসন্তুষ্টি রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাসে শেষ হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে ৮৭৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য। এক বছর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল ৭৬৮ কোটি ডলারের পণ্য। তার বিপরীতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ দেশটি থেকে আমদানি করেছে ২৫০ কোটি ডলারের পণ্য। অথচ এক বছর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি করেছিল ২৬২ কোটি ডলারের পণ্য। যুক্তরাষ্ট্র থেকে একক পণ্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় স্ক্র্যাপ লোহা বা লোহার টুকরা। আর দেশটিতে একক পণ্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করা হয় তৈরি পোশাক।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো জানায়, গমের পাশাপাশি উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ, ভোজ্যতেল, তুলা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ইত্যাদি আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ব্যবধান কমিয়ে আনবে বাংলাদেশ, যা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ আগে থেকেই ১৯০টি পণ্যের শুল্কহার শূন্য রেখেছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট করার সময় আরও ১০০ পণ্যকে এই তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। যদিও এ সুবিধা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্য দেশও পাবে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধি অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কোনো দেশের নির্দিষ্ট কোনো পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো যায় না। শুল্ক কমাতে হয় পণ্যের ওপর। কেউ যদি শুধু একটি দেশের কোনো পণ্যের ওপর শুল্ক কমায়, তাহলে অন্য কোনো দেশ ডব্লিউটিওর কাছে অভিযোগ করতে পারে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। বাণিজ্য কৌশল যেন এক দেশমুখী না হয়ে যায়। কারণ, রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অন্য অংশীদারদেরও অবদান কম নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে যে বাণিজ্য চাপ দেওয়া হচ্ছে, ডব্লিউটিওর ভূমিকা সেখানে হতাশাজনক।’

ডলারসংকটের এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চ দামে গম আমদানি, প্রতিযোগিতার বাইরে গিয়ে অন্য পণ্য আমদানির উদ্যোগ এবং আপাতত চাহিদা না থাকলেও উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ আমদানির কথা যে শোনা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, দর-কষাকষি পর্যায়ে যেটুকু অঙ্গীকার করা দরকার, সেটুকুই করতে হবে। চুক্তি যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তা বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ হবে।