
শরীরে ট্যাটু ছাড়া এখন কোনো ফুটবলার আছে নাকি—এ প্রশ্ন এখন উঠতে পারে। ফুটবলারদের ট্যাটুপ্রীতি বা উল্কি করানোর প্রতি টান আসলে নতুন কিছু নয়। ব্যতিক্রমও আছে। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর যেমন ট্যাটুপ্রীতি নেই। তাঁর শরীরে কোনো ট্যাটু নেই। তবে ট্যাটু করানো ফুটবলারের সংখ্যাই হয়তো বেশি হবে। আর দিন দিন এ ব্যাপারটা এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে ট্যাটু যেন এখন ফুটবলারদের শরীরের ইউনিফর্ম। লিওনেল মেসিই–বা বাদ যাবেন কেন; তাঁর হাত, বুক, পিঠ পা—সব জায়গাতেই তো ট্যাটু। আজ মেসির ৩৮তম জন্মদিনে আসুন তাঁর ট্যাটুগুলো সমন্ধে জেনে নেওয়া যাক—
সংবাদমাধ্যমে এর আগে জানা গিয়েছিল, মেসির শরীরে মোট ১৮টি ট্যাটু। তবে সংখ্যাটা একদম সঠিক না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, কিছু ট্যাটু নতুন করে করিয়েছেন মেসি। কিছু আবার নতুন ট্যাটুতে ঢেকেও ফেলেছেন। যদিও প্রতিটি ট্যাটুই অর্থবোধক। অর্থাৎ এমনিতেই করাননি, তাঁর প্রতিটি ট্যাটুর পেছনে অর্থ আছে।
মেসির কাছে পরিবার সবার আগে। তাঁর শরীরে প্রথম ট্যাটুটি তাঁর মায়ের প্রতিকৃতি, যেটা তিনি করিয়েছিলেন ২০১১ সালে। মা সেলিয়া কুচিত্তিনির প্রতিকৃতির এই ট্যাটুটি মেসির বাঁ কাঁধের পেছনে। আজ এত বড় অ্যাথলেট হয়ে ওঠার পেছনে যাঁর অবদান অনস্বীকার্য, তাঁকে ভালোবাসা ও সম্মান দিয়েই এই ট্যাটুটি করান মেসি।
এক বছর পর প্রথমবারের মতো বাবা হন মেসি। নিজের বাঁ পায়ের পেছনে সেই সন্তানের দুই হাতের ট্যাটু করান আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি। পরে দুটি হাতের মাঝে হৃদয়ের ট্যাটু এঁকে তাতে সন্তানের নামটিও লেখেন—থিয়াগো। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ডিয়েগো ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলের ট্যাটু মনে করে কেউ যেন ভুল না করে, সে জন্য সন্তানের নামও ট্যাটু করান মেসি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় সন্তান মাতেওর ট্যাটুও করান মেসি, সেটা তাঁর বাঁ হাতে।
এ তো গেল মা এবং সন্তানদের জন্য ট্যাটু। বউ আন্তোনেল্লা রোকুজ্জোর জন্যও তিনটি ট্যাটু করিয়েছেন মেসি। তাঁর ডান হাতের মাংশপেশিতে রোকুজ্জোর চোখের ট্যাটু করানো আছে। আছে চুমু খাওয়ার ভঙ্গিতে রোকুজ্জোর ঠোঁটের ট্যাটুও। দুজনের যৌথ ট্যাটুও আছে। রোকুজ্জোর শরীরে আছে রানির মুকুটের ট্যাটু আর মেসির শরীরে রাজার মুকুটের।
মেসির ডান হাতের মাংসপেশিতে রয়েছে পদ্মের ট্যাটু। রোজারিও সাদামাটা পরিবার থেকে উঠে এসে মেসির বিশ্ব জয়ের গল্পের প্রতীক এই ট্যাটু। পদ্মের ট্যাটুর অর্থ সাধারণত সহনশীলতা, পুনর্জন্ম ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা।
যে খেলাটির প্রতি তাঁর এত ভালোবাসা, সেই খেলা নিয়ে মেসির শরীরে কোনো ট্যাটু থাকবে না, তা হয় না। ফুটবলের একটি ট্যাটুও আছে মেসির শরীরে। আর ধর্মকে সম্মান করতে ডান হাতে এঁকেছেন যিশুর ট্যাটু। বার্সেলোনা শহরের ক্যাথলিক গির্জা সাগরাদা ফ্যামিলিয়া থেকে প্রেরণা নিয়ে শরীরে ‘রোজ উইন্ডো’ ট্যাটুও করিয়েছেন মেসি। এই গোলাপের চারপাশে কিছু ফুলও আঁকিয়েছেন মেসি। লাল গোলাপ, গোলাপি পদ্ম ও কমলার ফুল। এর মধ্য দিয়ে ক্যাথলিক বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রার্থনা, আধ্যাত্মিকতাবাদ এবং এর সৌন্দর্য বুঝিয়েছেন মেসি। তাঁর ডান হাতের কনুইয়ে রয়েছে একটি বড় ঘড়ি ও পেন্ডুলাম ঘড়ির যন্ত্রাংশের ট্যাটু। সময় যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ—সেটা বোঝাতেই এই ট্যাটু করিয়েছেন ইন্টার মায়ামি তারকা।
ফুটবলপ্রেমীদের কাছে মেসির শরীরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হওয়ার কথা তাঁর বাঁ পা। এই পায়ের জাদুতেই তো মাত করেছেন বিশ্ব। মেসির সেই বাঁ পায়ের ট্যাটুগুলো যেন তাঁর রূপান্তরের চিত্রিত গল্প। বাঁ পায়ের নিচের অংশে একসময় তলোয়ার, দেবদূতের ডানা ও একটি লাল গোলাপের ট্যাটু ছিল। পরে গাঢ় কালো কালির ট্যাটুতে সেসব ঢেকে দেন। তবে পায়ের পেছনে থিয়াগোর হাত ও তাঁর নামটা রেখেছেন এবং তার পাশেই ‘১০’ নম্বর লেখাটা—যেটা আসলে জাতীয় দল ও ক্লাবের হয়ে তাঁর জার্সি নম্বরের প্রতীকী ট্যাটু। হাঁটুর সামনের অংশে আছে বার্সেলোনার লোগোর ট্যাটু এবং তাস খেলার ‘ফাইভ অব কাপস’–এর ট্যাটুও আছে তাঁর পায়ে।
ডান পায়ে গোড়ালির ওপরের অংশে মেসি তাঁর তিন সন্তানের নাম ও জন্মস্থান লিখে ট্যাটু করিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, মেসির শরীরে কি বিশ্বকাপ জয়ের কোনো ট্যাটু আছে? এত ট্যাটু করালেন অথচ ২০২২ বিশ্বকাপ জয়ের স্মারক শরীরে রাখবেন না তা কি হয়? হয়। আবার হয়ও না। মানে মেসির শরীরে সরাসরি বিশ্বকাপের কোনো ট্যাটু নেই। তবে বাঁ পায়ের সামনের অংশে যে ‘ফাইভ অব কাপস’ ট্যাটু আছে, সেটা কাতার বিশ্বকাপ জয়ের পর করান মেসি। স্প্যানিশ এই ট্যারট কার্ডের আসলে কয়েক স্তরের অর্থ আছে।
প্রথমত, ‘পাঁচ’ সংখ্যাটি মেসির একদম ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের স্কোয়াড নম্বর। তার পরিবারের সবচেয়ে কাছের পাঁচজন মানুষেরও প্রতিনিধিত্ব করে এই সংখ্যা। এর পাশাপাশি এ সংখ্যাটা ‘সিন ইতার্নোস: ক্যাম্পেওনেস দে আমেরিকা’ তথ্যচিত্রের একটি মুহূর্তও মনে করিয়ে দেয়। মেসি এবং তাঁর পাঁচজন সতীর্থ লো সেলসো, ওতামেন্দি, দি মারিয়া, পাপু গোমেজ ও আগুয়েরোকে নিয়ে তাস খেলছিলেন, যেখানে মেসিকে বারবার ‘ফাইভ অব কাপস’ ডাকতে দেখা যায়, যেটা আসলে বড় কিছু বিজয়ের আগের পূর্বাভাস।
মেসির জন্য এই ‘ফাইভ অব কাপস’ ট্যাটুর অর্থ আসলে এসবের চেয়েও বেশি কিছু। নিজের আজন্ম লালিত বিশ্বাসের পূর্ণতাপ্রাপ্তি সেটি।