facebook twitter You Tube rss bangla fonts

ঢাকা, ০৯ মে বৃহস্পতিবার, ২০২৪

Walton

৪৩ বছরের মধ্যে এবার এপ্রিলে কালবৈশাখী কম হওয়ার কারণ


২৭ এপ্রিল ২০২৪ শনিবার, ১০:৫৮  এএম

স্টাফ রিপোর্টার

শেয়ার বিজনেস24.কম


৪৩ বছরের মধ্যে এবার এপ্রিলে কালবৈশাখী কম হওয়ার কারণ

কবি নজরুল ইসলাম বৈশাখী ঝড়ের কাছে আকুল হয়ে আবেদন করেছিলেন, ‘ওগো বৈশাখী ঝড়! ল’য়ে যাও অবেলায় ঝরা এ মুকুল। ল’য়ে যাও বিফল এ জীবন — এই পায়ে দলা ফুল।’ বৈশাখ মাসের সঙ্গে বৈশাখী ঝড়ের এক নিবিড় সম্পর্ক। মধ্য এপ্রিলে শুরু হওয়া বৈশাখের প্রায় অর্ধেকটা পার হয়েছে। কিন্তু এবার এ ঝড়ের সংখ্যা অনেক কম। আবহাওয়াবিদদের কাছে এ ঝড় হলো ‘বজ্রঝড়’।

দেশে সবচেয়ে বেশি বজ্রঝড় হয় মে মাসে। এরপর আছে জুন, সেপ্টেম্বর ও এপ্রিল মাস। কিন্তু এবার এই ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে মাত্র একটি বজ্রঝড় বা কালবৈশাখী হয়েছে। তাও হয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে। সেটাও অস্বাভাবিক। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ১৯৮১ সাল থেকে চলতি ২০২৪ সাল পর্যন্ত বজ্রঝড়ের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা প্রকৃতির এ আচরণকে অস্বাভাবিক বলছেন।

বজ্রঝড় বনাম কালবৈশাখী
দেশে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বজ্রঝড় হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকারের মতে, সব কালবৈশাখীই বজ্রঝড়। কিন্তু সব বজ্রঝড় কালবৈশাখী নয়।

কারণ কী? এই আবহাওয়াবিদের সহজ ব্যাখ্যা, মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত যেসব বজ্রঝড় হয় সেগুলো আসলে কালবৈশাখী। এর ইংরেজি প্রতিশব্দের সঙ্গে মিলিয়ে বলা যায়, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা বায়ুর কারণে এই ঝড়বৃষ্টি হয়। তাই একে ইংরেজিতে ‘নরওয়েস্টার’ বলে।

এপ্রিলে ঝড় কমছে
এপ্রিল মাসে সাধারণত প্রচণ্ড গরম হয়। আবার এক সময় বজ্রঝড় হয়ে সেই গরম প্রশমিত হয়। তারপর আবহাওয়া একসময় আবার গরম হয়। এভাবে তাপ ও ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে চলে এ মাস। কিন্তু দিন দিন এপ্রিল মাসে তাপ্রবাহ বাড়ছে আর কমছে বজ্রঝড়ের সংখ্যা।

চলতি এপ্রিল মাসে গত ৭৬ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে তাপপ্রবাহ ছিল। এ মাসের ১ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে তাপপ্রবাহ। আজ ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত তা চলছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. উমর ফারুক বলেন, ১৯৪৮ সাল থেকে উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছি, এবারের মতো তাপপ্রবাহ টানা আগে হয়নি। এবার ৭৬ বছরের রেকর্ড এবার ভেঙে গেল।’

এই তাপপ্রবাহের মাসে বজ্রঝড় বা কালবৈশাখীর সংখ্যা গেছে কমে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি ১৯৮১ থেকে চলতি বছরের এপ্রিল মাসের উপাত্ত তুলে ধরেছেন তাঁর গবেষণায়। এই ৪৩ বছরে এপ্রিল মাসে ৩৬৫টি বড় বজ্রঝড় হয়। সবচেয়ে বেশি ঝড় হয়েছিল ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে, ১৪টি। আর ১৯৯৯ এবং ২০০৯ সালে সবচেয়ে কম চারটি করে ঝড় হয় এপ্রিলে। গত বছরের এপ্রিলে বজ্রঝড় হয়েছিল সাতটি। ২০২২ এবং ২০২১ সালে হয় যথাক্রমে নয়টি ও আটটি। আর এ বছর মাত্র একটি।

দক্ষিণের বজ্রঝড় অস্বাভাবিক
চলতি মাসের ৭ তারিখ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাটের বিভিন্ন স্থানে বজ্রঝড় বা কালবৈশাখী বয়ে যায়। ঝড়ের সময় বজ্রপাতে বাগেরহাটে একজনের মৃত্যুও হয়। তবে দক্ষিণ জনপদের মানুষের কাছে এ সময় ঝড় বেশ অস্বাভাবিক।

পিরোজপুর শহরের বাসিন্দা জগৎপ্রিয় দাশ (৬৭) কৃষি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। শহরের নাসিরনগরের এই বাসিন্দা বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতায় এ সময়ে এত বড় ঝড় দেখিনি। এ সময়ে দক্ষিণ এলাকায় সাধারণত এমন ঝড় হয় না।’

দক্ষিণের সাধারণ মানুষের মতো এ সময়ের বজ্রঝড় ভাবিয়েছে আবহাওয়াবিদদেরও। আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলছিলেন, ‘এ সময়ের ঝড় সাধারণত দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে মধ্যাঞ্চলে শুরু হয়। এবার এর ব্যতিক্রম ঘটল। এবার একটিই ঝড় দেখা গেল এ মাসে, তা-ও স্বাভাবিক স্থানে নয়।’

এপ্রিল মাসে ঝড় কমে যাওয়ায় অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহকেই কারণ মনে করেন বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) সঙ্গে যুক্ত।

সাইফুল বলেন, তাপমাত্রা বৈশ্বিকভাবে ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। এ বছরের এপ্রিল ভারতে ১২২ বছরের মধ্যে ছিল সবচেয়ে বেশি উষ্ণ। আমাদের যে বায়ুপ্রবাহ তার সঙ্গে সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ওডিশার সম্পর্ক আছে। এ সময় এসব অঞ্চলে সাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্প বজ্রমেঘের সৃষ্টি করে। কিন্তু এবার ভারতের ওই সব অঞ্চলেও প্রচণ্ড গরম পড়েছে। আর্দ্রতাপূর্ণ জলীয় বাষ্প জড়ো হয়ে বজ্রমেঘ সৃষ্টি করেনি। তাতেই এ বিড়ম্বনা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এ অবস্থা দেখছি আমরা।

বাংলাদেশের ঝড় নিয়ে ‘ক্লাইমেট ফিচার অব দ্য থান্ডারস্টর্ম ডেইজ অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম ফ্রিকোয়েন্সি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা করেছেন আবহাওয়াবিদ সমরেন্দ্র কর্মকার। তার মতে, ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশার উপকূলে সৃষ্টি সক্রিয় নিম্নচাপ বাংলাদেশের প্রবেশ করে মার্চ ও এপ্রিল মাসে বজ্রঝড় ঘটায়। কিন্তু তা হচ্ছে না বা কম হয়েছে। এখানে জলীয় বাষ্পের সঙ্গে আর্দ্রতার একটি মেলবন্ধন ঘটে। সেটি ঘটছে না। বাতাস মিয়ানমারের দিকে চলে যাচ্ছে।

তবে কয়েক দিনের অপেক্ষার পর বাংলাদেশে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হতে পারে বলে মনে করেন এই আবহাওয়াবিদ। আর তখন বজ্রঝড়ের মাত্রা অনেকটা প্রবল হতে পারে বলেও মনে করেন সমরেন্দ্র কর্মকার।

সাইফুল ইসলাম ও সমরেন্দ্র কর্মকার—দুই আবহাওয়াবিদেরই অভিমত, বজ্রঝড় ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় বজ্রমেঘের জোগান হচ্ছে না। এর জন্য মাত্রাতিরিক্ত তাপই দায়ী। আর এর কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা।

পরিবেশের ওপর প্রভাব
অতি তাপপ্রবাহের ফলে সাগর ও ভূমিতে থাকা জলীয় বাষ্প প্রবল হয়ে উঠতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। আর এর কারণে এরপর যখন বৃষ্টি শুরু হবে তার পরিমাণ বেশি হতে পারে। এরই মধ্যে ভারতের আবহাওয়া অফিস বলেছে, এবার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় বর্ষা হতে পারে।

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় বায়ু প্রবাহ এল নিনো সক্রিয় ছিল। আর এর ফলে ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস আগের যে কোনো বছরের চেয়ে ছিল উষ্ণ। আর এই তাপের কারণে বজ্রঝড় কম হওয়া দেশের পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বজ্রঝড়ের তাণ্ডবে ঘরবাড়ি ও গাছপালা ভাঙে। ফসলেরও ক্ষতি হয় অনেক সময়। কিন্তু এর ফলে হওয়া বৃষ্টি ফসলের জন্য খুব উপকারীও।

কৃষিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায় বলছিলেন, এখন বৃষ্টি না হওয়ায় যেসব ধান মাঠে আছে এবং পুষ্ট হয়নি সেগুলো চিটা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আমের গুটি ঝরে যাচ্ছে। নিজের মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আম গাছের নিচে ছড়িয়ে আছে গুটি। বাগানিরা গোড়ায় পানি দিচ্ছেন। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। ওপর থেকে বৃষ্টি চাই। তা হচ্ছে না।’

এ সময় পানি পেলে বাড়ত ব্যাঙাচি এবং গঙ্গা ফড়িং। এ দুইই মশা খায়। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় ব্যাঙাচি এবং গঙ্গা ফড়িংয়ের বংশ বিস্তার কম হতে পারে। ফলে মশার উপদ্রব আগামীতে বাড়তে পারে বলে মনে করেন মৃত্যুঞ্জয় রায়।

শেয়ারবিজনেস24.কম এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট বিনা অনুমতিতে ব্যবহার বেআইনি।

আপনার মন্তব্য লিখুন: