
বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক অনন্য নাম সেতারা মূসা। ষাটের দশকে যখন নারীদের জন্য সাংবাদিকতা ছিল এক কঠিন ও অচেনা পথ, তখনই এই সাহসী নারী কলম হাতে এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি শুধু সংবাদ জগতে পথিকৃতই নন, ছিলেন কর্মচঞ্চল ও প্রাণবন্ত এক সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব। গৃহিণী হিসেবে সংসার সামলানোর পাশাপাশি যে দক্ষতায় সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় নিজের জায়গা করে নিয়েছেন, তা সত্যিই অনুকরণীয়।
১৯৪০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার লাকসামে জন্ম সেতারা মূসার। তাঁর বাবা ছিলেন খ্যাতিমান সম্পাদক আব্দুস সালাম, যিনি তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার ও বাংলাদেশ অবজারভারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। শৈশবের সাতটি বছর কেটেছে কলকাতায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। পড়াশোনার শুরু নারীশিক্ষা মন্দিরে, এরপর কামরুন্নেসা স্কুলে। ক্লাস নাইনে থাকাকালে বিয়ে হয় বিশিষ্ট সাংবাদিক এবিএম মূসার সঙ্গে।
শিক্ষা-জীবন চালিয়ে গিয়ে তিনি ১৯৬০ সালে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক এবং পরে সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাশ করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভের পর ১৯৬৮ সালে পূর্বদেশ পত্রিকায় ফিচার সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পাশাপাশি নারী পাতার দায়িত্ব পালন করেন এবং সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’-তে টেলিভিশন বিষয়ক কলাম লিখে পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি রেডিও ও টিভির নাট্যকার হিসেবেও সক্রিয় ছিলেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি সচিত্র স্বদেশ এবং দৈনিক জনতা পত্রিকায় মহিলা পাতার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। পেশাগত মান উন্নয়নে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘মহিলা সাংবাদিক ফোরাম’, যেখানে সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। সেতারা মূসা শুধু সাংবাদিকতায় নয়, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও ছিলেন গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তিনি বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশন, ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন ও বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সমিতিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
নারীকল্যাণে তাঁর উদ্যোগ ছিল ব্যতিক্রমী। নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলেন ‘সুরুচি সংসদ’, যার মাধ্যমে পাড়ার নারীদের সংগঠিত করেন এবং পথশিশুদের জন্য চালু করেন বিনামূল্যের স্কুল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন সমাজসেবার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।
২০২৩ সালের ১৪ মার্চ ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বহুমুখী প্রতিভার এই নারী আমাদের ছেড়ে চলে যান। সেতারা মূসা কেবল একজন সাংবাদিক ছিলেন না, ছিলেন এক যুগপ্রবর্তক নারী, যিনি নারী সাংবাদিকতার জগতে রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় ছাপ।
আরও