
রংপুরের বদরগঞ্জের আমরুলবাড়ি মৌলভীপাড়া গ্রামের মাস্টার্স পাশ দম্পতি মশিউর রহমান ও সুমি খাতুন চাকরির পিছনে না ছুটে সফল উদ্যোত্তা হয়েছেন। তাঁরা খামারে মুরগি, হাঁস, গরু, ছাগল পালনসহ মাছ চাষ করে বছরে গড়ে আয় করছেন ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। কিনেছেন এলাকায় মুল্যবান সাড়ে চার একর জমি। বর্তমানে মশিউর দম্পতির স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে পাঁচ কোটি টাকার ওপরে। মশিউর ২০২৪ সালে উপজেলা শ্রেষ্ঠ মৎস্যচাষি হিসেবে পুরস্কৃত হন। তাঁদের খামারে সাফল্য দেখে এলাকার বেকার শিক্ষিত যুবকরাও ঝুঁকছেন সেই দিকে। পাল্টে যাচ্ছে এলাকার অর্থনৈতিক চিত্র।
মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান মশিউর: মশিউরের বাবা রফিকুল ইসলাম একজন কৃষক, মা মোসলেমা বেগম গৃহিনী। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মশিউর সবার বড়। খামার করার পাশাপাশি মশিউর ২০১৭ সালে কারমাইকেল কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে মাস্টার্স পাশ করেন। তিনি ছোট বোন ফাতেমা বেগমকে মাস্টার্স পাস করে এবং আরেক বোন ইতিমনিকে এইচএসসি পাশ করে বিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ছোট ভাই মোসলেম হক পঞ্চম শ্রেণি পাশ করে আর লেখাপড়া করেননি। মোসলেমও তাঁর খামার দেখাশোনা করছেন।
পেছনের গল্প: সালটা, ২০০৯। তখন মশিউর রহমান মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। কলেজের প্রথম ক্লাস নিতে যান গর্ভণিং বডির সভাপতি ও তৎকালীন সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মন্ডল। ক্লাসে গিয়ে তিনি সবার কাছে জানতে চান লেখাপড়া শেষ করে কার কি হওয়ার স্বপ্ন। ক্লাসের শতাধিক শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেকে বলেছিলেন চিকিৎসক ও ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা। বাকীরাও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা ও শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে একমাত্র মশিউর একজন উদ্যাক্তা হওয়ার ইচ্ছা পোষন করেন। তাঁর এ কথা শুনে ক্লাসের সবাই হেসে উঠেন। তখন সভাপতি মশিউরকে প্রশ্ন করেন, সবাই সরকারি চাকরিজীবী হতে চায়, তুমি কেন উদ্যোক্তা হতে চাও- সভাপতির এমন প্রশ্নের উত্তরে মশিউর বলেন, ‘স্যার, দেখেন আমাদের মত গরীব ঘরের ছেলে মেয়েরা লেখা পাড়া অবস্থায় কেউ কৃষি কাজ করতে চায় না। লেখাপড়া শেষ করে মামা-খালু না থাকায় সরকারি চাকরিও পায় না। পরে এসে অন্য কোনো কাজও করতে পারে না। সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে হতাশায় জীবন যাপন করতে হয়। এ কারণে আমি সেই হতাশা নিয়ে জীবন যাপন করতে চাই না।’ মশিউরের কথায় সায় দিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে সভাপতি বলেন, দারুণ কথা বলেছে মশিউর, তোমরা (ক্লাসের অন্যান্য শিক্ষার্থী) না হেসে মশিউরের কথা অনুসরণ করে লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়িতে কোনো একটা কাজে লেগে যাও, দেখবা সফলতা একদিন আসবেই। ওইদিন থেকে মশিউরকে দেখলেই সহপাঠিরা মজা করে বলতে থাকে কি রে আজ বাড়িতে কী কাজ করলি? এ কথা শুনে মশিউর কখনও রেগে যেত, আবার কখনও নিরব থাকতো। সহপাঠিদের এমন ঠাট্টা হাসি সহ্য করতে না পেরে ওই সময়ে প্রতিজ্ঞা করেন দেরিতে নয়, এখনেই তাঁকে লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়িতে মুরগি’র খামার গড়ে তুলতে হবে তাই বাড়ির পাশে একটি মুরগীর খামার গতে তুলেন। খামার নির্মাণ ও ২ হাজার মুরগীর বাচ্ছা কিনে খাদ্য সহ আনুমানিক খরচ হয় আড়াই লাখ টাকার মতো। তার এই কাজে দুই বন্ধু সাহায্যের হাত বারিয়ে দেন। খামারের নাম দেন “মেসার্স তানিয়া এগ্র ফার্মার”। বর্তমানে তার খামারের ১৩টি ইউনিটে ১৮ হাজার মুরগী, ২ হাজার হাঁস, ১০টি গরু, ২০টি ছাগল রয়েছে। এছাড়াও ৫ একর জমির ওপর ৫টি পুকুরে প্রায় ৭০ হাজার পাঙাস মাছসহ অন্যান্য প্রজাতির মাছ রয়েছে। প্রতিটি পাঙাস-এর ওজন ৭-৮’শ গ্রাম । বর্তমানে তার খামারে ১৫-২০ জন শ্রমিক কাজ করছেন।
মাস্টার্স পাশ দম্পতি: ২০১৪ সালে মশিউর রহমান কারমাইকেল কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত অবস্থায় পারিবারিকভাবে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয় পাশ্ববর্তী তারাগঞ্জ উপজেলা ইকরচারি গ্রামের সুমি খাতুনের সঙ্গে। বিয়ের সময়ে সুমি খাতুন এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা দেন। সুমি খাতুন বলেন, আমি শ্বশুর বাড়িতে এসে দেখি আমার স্বামী মুরগি ও মাছ চাষে ব্যস্ত সময় পার করার পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর কঠোর পরিশ্রম দেখে মুগদ্ধ হলাম। ভাবলাম স্বামী পারলে আমি পারবো না কেন!- এমনটা ভেবে আমিও তাঁর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, পাশাপাশি সংসার ও লেখাপড়াও চালিয়ে গেলাম। ২০১৭ সালে আমার স্বামী কারমাইকেল কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাস নিয়ে মাস্টার্স পাশ করেন এবং একই কলেজ থেকে আমিও ২০১৯ সালে বাংলা বিভাগে মাস্টার্স পাশ করি। আমরা দুইজন কখনই চাকরির পিছনে ছুটিনি। সুমি খাতুন বলেন, আমরা চাকরি করলে হয়তো দু’জনেই ভালো থাকতাম। কিন্তু কারও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতাম না। এখন আমাদের এখানে ১৫-২০জন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। আমাদের সাফল্য দেখে এলাকার অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক হতাশ না হয়ে মুরগি পালনসহ মাছ চাষে ঝুঁকছেন। অনেকেই আসছেন আমাদের কাছে পরামর্শ নিতে। পরামর্শ দিতে খুব ভালো লাগছে নিজেকে।
মশিউর রহমান বলেন, আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবাকে কৃষি কাজে সহযোগিতা করতাম। বাবার কষ্ঠ দেখে আমি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখি। আল্লাহ আজ আমার সেই স্বপ্ন পূরন করেছেন। তিনি আরো বলেন, ‘যে কাজেই হোক, তা মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। কারণ কঠোর পরিশ্রম ও শরীরের ঘাম কখনও কারও সঙ্গে বেইমানী করে না। একদিন সফলতা আসবেই।’
বদরগঞ্জ উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা উম্মে হাবিবা মুমু বলেন, ‘মশিউর একজন উপজেলার সফল মৎস্য চাষি। তাঁকে আমরা ২০২৪ সালে শ্রেষ্ঠ মৎস্য চাষি হিসেবে পুরস্কৃত করেছি। আশা করি তাঁকে দেখে এলাকার বেকার শিক্ষত যুবকরাও মাছ চাষের দিকে ঝুঁকবেন। উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. স্বপন চন্দ্র রায় বলেন, ‘মাস্টার্স পাশ মশিউর দম্পতি পোট্রি খামার করে সফলতার মুখ দেখেছেন। আমি সুযোগ পেলে তাঁদের খামার পরিদর্শনে যাই এবং সঠিক পরামর্শ দেই।’