
জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে ক্রমাগত ধস নামায় সরকারের অর্থ জোগানে ব্যাংক নির্ভরতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় জনগণ কেন সঞ্চয়পত্রে আগ্রহ হারাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয় জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরকে এ সংক্রান্ত কারণ চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে প্রাপ্ত মুনাফার হার প্রায় একই হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেতিবাচক প্রবণতায় রয়েছে। সম্প্রতি অর্থ সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘ক্যাশ অ্যান্ড ডেট ম্যানেজমেন্ট কমিটি’র এক বৈঠকে সরকারের রাজস্ব ঘাটতি, সুদের খরচ এবং নগদ অবস্থান পর্যালোচনা করা হয়।
বৈঠকে জানা যায়, ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে, যার ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত হচ্ছে যা কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে অন্তরায়। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনে। কিন্তু ১৫ জুন পর্যন্ত সেই লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ব্যাংক ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফেরত দিয়েছে ২২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ফলে মোট নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, সঞ্চয়পত্র বিক্রির চিত্র একেবারেই ভিন্ন। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল এই ১০ মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি নেতিবাচক হয়েছে ৭ হাজার ৪৩১ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ, যতো সঞ্চয়পত্র ইস্যু হয়েছে, তার চেয়েও বেশি পরিমাণে লোকজন নগদায়ন করেছে।
অর্থ বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “এক সময় সঞ্চয়পত্রে এত বেশি বিনিয়োগ হচ্ছিল যে সরকার বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু অবৈধ আয়ের বিনিয়োগ ঠেকাতে ও ধনীদের অংশগ্রহণ কমাতে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা হয় কর সনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নম্বর। এরপর থেকেই বিনিয়োগের হার কমে যেতে থাকে।” তিনি আরও জানান, এখন নতুন করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্র যেখান থেকেই ঋণ নেওয়া হোক না কেন, সরকারের উচিত নিজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি এখন খুবই দুর্বল, যার অর্থ হচ্ছে মানুষের হাতে সঞ্চয় করার মতো অতিরিক্ত টাকা নেই।”
তিনি আরও বলেন, “সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ মূলত মেয়াদি বিনিয়োগ। এর জন্য মানুষের হাতে বাড়তি অর্থ থাকতে হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকের পক্ষেই তা সম্ভব হচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেন, “ঋণনির্ভরতার পরিবর্তে সরকারের উচিত রাজস্ব আদায় বাড়ানো। এতে করে ব্যয় নির্বাহে স্বাধীনতা আসবে এবং বাজেট ঘাটতিও নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। ”সংক্ষেপে মূল তথ্য: চলতি অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৯৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকাসঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি নেতিবাচক: ৭ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা টিআইএন বাধ্যতামূলক করার পর বিনিয়োগ কমেছে রাজস্ব বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।