ঢাকা   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

নওগাঁয় শব্দদূষণে নীরব বিপদ, আইন থাকলেও নেই কার্যকর প্রয়োগ

গ্রামবাংলা

নওগাঁ প্রতিনিধি:

প্রকাশিত: ০১:২৬, ১ জুলাই ২০২৫

সর্বশেষ

নওগাঁয় শব্দদূষণে নীরব বিপদ, আইন থাকলেও নেই কার্যকর প্রয়োগ

নওগাঁ শহরে শব্দদূষণের মাত্রা দিনে দিনে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। রয়েছে আইন, গেজেট ও বিধিমালা—তবু নেই তার বাস্তব প্রয়োগ। ফলে শহরের পরিবেশ যেমন প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাচ্ছে, তেমনি জনস্বাস্থ্যের উপর পড়ছে মারাত্মক প্রভাব।

২০০৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে একটি গেজেট প্রকাশ করা হয়। তাতে স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে কোন এলাকায় কত ডেসিবল মাত্রার শব্দ গ্রহণযোগ্য এবং কে কী দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু সেই গেজেটে জেলা পর্যায়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা অস্পষ্ট। শুধু জেলা প্রশাসক ও ইউএনওদের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

স্বাস্থ্যে ভয়াবহ প্রভাব

নওগাঁ মেডিকেল কলেজের ইএনটি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মিলন কুমার চৌধুরী জানান, শব্দের সহনীয় মাত্রা ৬০ ডেসিবল পর্যন্ত। কিন্তু নওগাঁ শহরে প্রতিনিয়ত ৮০ থেকে ৯০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে। এ মাত্রার শব্দ শিশু ও বয়স্কদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

তিনি বলেন, "শব্দ কানের স্পর্শকাতর অংশে আঘাত করে শ্রবণশক্তি ধ্বংস করে দেয়। মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করে। চিন্তা ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা কমে যায়। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাবে রক্তচাপ বেড়ে যায়, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। অনেক সময় ‘টিনিটাস’ নামক সমস্যার কারণে মানুষ আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।"

শিক্ষার্থী ও নাগরিকদের দুর্ভোগ

নওগাঁর বিভিন্ন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও নাগরিকরা বলছেন—অপ্রয়োজনীয় হর্ন, সাউন্ড বক্স ও মাইকিংয়ের কারণে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া বলেন, “অযথা মাইক বাজানোয় পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া যাচ্ছে না।”
শিক্ষার্থী সিবলী সাদিক বলেন, “এমন শব্দে কিছুই বোঝা যায় না, পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
টাইলস মিস্ত্রি জাহাঙ্গীর বলেন, “সারাদিনের কাজ শেষে কানে যেন কিছুই শুনি না, বড় শব্দে কথা বলতে হয়, অভ্যাস হয়ে গেছে।”

বক্তব্য শিক্ষকদের

তেতুলিয়া বিএমসি কলেজের অধ্যক্ষ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “নওগাঁ শহরে সবচেয়ে বড় দূষণ হচ্ছে শব্দদূষণ। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল কোনো কিছুই রেহাই পাচ্ছে না।”
ফয়েজ উদ্দীন কলেজের শিক্ষক আব্দুস সালাম বলেন, “শব্দদূষণ এখন মানুষের জীবনের একটি নীরব ঘাতক হয়ে উঠেছে।”

আইন আছে, তবু কার্যকর নয়

২০০৬ সালের গেজেট অনুযায়ী,

  • নীরব এলাকায়: দিনে ৫০, রাতে ৪০ ডেসিবল

  • আবাসিক এলাকায়: দিনে ৫৫, রাতে ৪৫ ডেসিবল

  • মিশ্র এলাকায়: দিনে ৬০, রাতে ৫০ ডেসিবল

  • বাণিজ্যিক এলাকায়: দিনে ৭০, রাতে ৬০ ডেসিবল

  • শিল্প এলাকায়: দিনে ৭৫, রাতে ৭০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দমাত্রা অনুমোদিত।

গেজেটে আরও বলা হয়েছে, ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দিনকাল এবং রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত রাতকাল হিসেবে বিবেচিত হবে।
তবে এসব নিয়ম মানা তো হচ্ছেই না, বরং নির্বিঘ্নে চলছে উচ্চশব্দের হর্ন, মাইক, সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহার।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সীমাবদ্ধতা

নওগাঁ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. নাজমুল হোসাইন বলেন, “২০০৬ সালের গেজেট অনুযায়ী জেলা পর্যায়ের পরিবেশ অফিসের করণীয় স্পষ্ট নয়। গেজেটে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসক ও ইউএনওকে। বর্তমানে আমাদের কিছু কার্যক্রম থাকলেও গেজেট হালনাগাদ না হওয়ায় তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন।”

প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, “শব্দদূষণ অবশ্যই বড় একটি সমস্যা। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

নওগাঁতে শব্দদূষণ এখন কেবল একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, এটি একটি জনস্বাস্থ্য সংকট। আইন ও বিধিমালা থাকলেও প্রয়োগের অভাবে সমস্যা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এখন প্রয়োজন শুধু প্রশাসনের কঠোর নজরদারি, আইন প্রয়োগ ও জনসচেতনতা—এই তিনের সমন্বিত উদ্যোগ।

 

সর্বশেষ