ঢাকা   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

অবৈধ অভিবাসনের ছাপ, কমছে গ্রহণযোগ্যতা

ভ্রমণ

শেয়ারবিজনেস ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ১২ মে ২০২৫

আপডেট: ০৮:৪৬, ১২ মে ২০২৫

সর্বশেষ

অবৈধ অভিবাসনের ছাপ, কমছে গ্রহণযোগ্যতা

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বাংলাদেশের পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও এখন সেই চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। একের পর এক দেশ বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা নীতিতে কঠোরতা আনছে বা পুরোপুরি ভিসা বন্ধ করে দিচ্ছে। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে পর্যটক সেজে বিদেশ গিয়ে কাজ শুরু করা কিংবা ইউরোপমুখী অবৈধ অভিবাসন প্রবণতা।

বিশেষ করে ভিয়েতনাম একসময় বাংলাদেশিদের জন্য অন অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা দিলেও, ২০২৫ সালের শুরু থেকে এই সুবিধা পুরোপুরি বন্ধ করেছে। কারণ, ভিয়েতনামে যাওয়ার পর বহু বাংলাদেশি আর দেশে ফেরেননি। অনেকে স্থানীয়ভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেছেন, কেউ আবার ইউরোপে চলে গেছেন। ভিয়েতনামের এই সিদ্ধান্তে প্রভাব পড়েছে কম্বোডিয়া ও লাওস ভ্রমণেও, যেগুলো সাধারণত ভিয়েতনাম হয়ে যাওয়া হতো।

শুধু ভিয়েতনাম নয়, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরও বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়ায় নতুন শর্ত আরোপ করছে। আবেদন প্রত্যাখ্যানের হার বেড়ে গেছে, বিশেষ করে নতুন পাসপোর্টধারীদের ক্ষেত্রে। এর ফলে প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণে আগ্রহীদের জন্য এই দেশগুলো হয়ে উঠছে প্রায় অপ্রবেশযোগ্য।

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাতও গত বছর জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশিদের পর্যটন ও কর্মসংস্থান ভিসা ইস্যু কার্যত বন্ধ রেখেছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে সীমিত আকারে প্রতিদিন মাত্র ৩০–৫০টি ভিসা ইস্যু করা হচ্ছে, কিন্তু এতে প্রয়োজনের তুলনায় সাড়া মিলছে না।

অন্যদিকে ভারত, যা দীর্ঘদিন বাংলাদেশের পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় গন্তব্য ছিল, সেখানেও ভিসা পাওয়া বর্তমানে কঠিন হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার পর ভিসা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এখন শুধুমাত্র জরুরি চিকিৎসা ভিসা মিলছে। ফলে ভারত হয়ে নেপাল ও ভুটান ভ্রমণও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

পাকিস্তান ভিসা প্রক্রিয়া কিছুটা সহজ করেছে এবং ঢাকা-করাচি ফ্লাইট চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও, সাম্প্রতিক নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে আগ্রহ কমেছে। ফলে এই রুটও প্রত্যাশিত জনপ্রিয়তা পায়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশিদের অবৈধ অভিবাসনের প্রবণতা, পর্যটক সেজে কর্মসংস্থানের চেষ্টা এবং দেশে না ফেরার প্রবণতা বিদেশি সরকারগুলোকে সতর্ক করে তুলেছে। হেনলি পাসপোর্ট সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে ৯৫তম, যা উত্তর কোরিয়া ও লিবিয়ার সমান। অন্যদিকে, নোমাড ক্যাপিটালিস্ট সূচকে অবস্থান ১৮১তম—বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট অবস্থান।

বাংলাদেশিদের অবৈধ অভিবাসনের হার বেড়ে যাওয়ায় নতুন পাসপোর্টধারীদের প্রতি বিদেশি দূতাবাসগুলোর আস্থা কমেছে। অনেকেই ভারত বন্ধ থাকায় সরাসরি থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরে আবেদন করছেন, ফলে এসব দেশের ওপর বাড়তি চাপ পড়ছে এবং ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার বাড়ছে।

ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, বিগত কয়েক বছরে সেখানে যাওয়া বাংলাদেশিদের ৬০–৭০ শতাংশই ফেরেননি। এই ধারা রোধে দেশটি বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করেছে।

বিশ্লেষণ ও পরামর্শ:

এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের জন্য একটি অশনিসংকেত। ভ্রমণ স্বাধীনতা বৈশ্বিক সংযোগ, বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ এই সুযোগের অপব্যবহার করায় ভিসা নীতিতে কড়াকড়ি আসছে, যার ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নিরীহ ও প্রকৃত ভ্রমণেচ্ছুদের।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশি নাগরিকদের বিদেশে অভিবাসনের ইচ্ছা স্বাভাবিক হলেও, অবৈধ পন্থা বেছে নেওয়া আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে এবং দেশের ভাবমূর্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। সরকার যদি বিদেশে কর্মসংস্থানের আরও সুযোগ সৃষ্টি করে এবং সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত অভিবাসন কাঠামো গড়ে তোলে, তাহলে বিদেশি সরকারের আস্থাও ফিরতে পারে।

ভিসা প্রত্যাখ্যান হারের একটি বড় কারণ হলো আবেদনকারীদের পর্যাপ্ত দলিল না থাকা, উদ্দেশ্য অস্পষ্ট থাকা এবং আর্থিক সামর্থ্যের যথাযথ প্রমাণ দিতে না পারা। তাই আগ্রহীদের প্রয়োজন যথাযথ প্রস্তুতি, প্রকৃত তথ্য প্রদান এবং দালাল নির্ভরতা কমানো।

উপসংহার:

ভ্রমণ আর শুধু পাসপোর্ট থাকলেই সম্ভব—এখন দরকার একটি বিশ্বাসযোগ্য পরিচিতি, নির্ভরযোগ্য আর্থিক প্রোফাইল এবং আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি সম্মান। অবৈধ অভিবাসনের কারণে বাংলাদেশি পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা যেভাবে কমছে, তা থামাতে হলে ব্যক্তিগত সচেতনতা, সরকারিভাবে কার্যকর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো জরুরি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভিসা জটিলতা কাটাতে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হয়েছে। তবে এই আলোচনার ফল কেবল তখনই টেকসই হবে, যদি দেশের নাগরিকরা বৈধ ও নৈতিক ভ্রমণ আচরণ বজায় রাখেন।

সর্বশেষ