
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত পাঁচটি ঋণগ্রস্ত কোম্পানির সার্বিক কার্যক্রমে বিশেষ তদন্ত চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক অনিয়ম, বিপুল ঋণের ভার এবং তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছতার ঘাটতিতে ভুগছে। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষায় বিএসইসি এবার বিষয়টি নিয়ে মাঠে নামছে।
চার সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি
তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি। এতে নেতৃত্ব দেবেন অতিরিক্ত পরিচালক মুহাম্মদ জিয়াউর রহমান। অন্য সদস্যরা হলেন উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান রনি এবং মো. আবু হেনা মোস্তফা। এই কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
যেসব কোম্পানি তদন্তের আওতায়
বিএসইসির তদন্তের আওতায় এসেছে—
১. বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস
২. বেক্সিমকো লিমিটেড
৩. শাইনপুকুর সিরামিকস
৪. রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস (RSRM)
৫. নিউলাইন ক্লোথিংস লিমিটেড
উল্লেখযোগ্য যে, প্রথম তিনটি কোম্পানি বেক্সিমকো গ্রুপভুক্ত, যাদের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের ঋণ গ্রহণ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতার ঘাটতির অভিযোগ রয়েছে।
তদন্তের পরিধি
তদন্ত কমিটি কোম্পানিগুলোর কারখানা, অফিস, ব্যাংক হিসাব, আর্থিক নথিপত্র ও আয়-ব্যয়ের হিসাব বিশ্লেষণ করবে। এছাড়া উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ারধারণ, বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম), অভ্যন্তরীণ লেনদেন এবং বিনিয়োগকারীদের সাথে তথ্য বিনিময়ের স্বচ্ছতা কতটা বজায় রাখা হয়েছে, তাও খতিয়ে দেখা হবে।
কমিটি দেখতে চায় কোম্পানিগুলো সিকিউরিটিজ আইন ও বিএসইসির বিধিবিধান যথাযথভাবে মানছে কি না। তদন্ত শেষে অনিয়ম ধরা পড়লে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ারও ইঙ্গিত রয়েছে কমিশনের অভ্যন্তরে।
ঋণের চিত্র বিশ্লেষণে চমক
বেক্সিমকো গ্রুপের আর্থিক অবস্থা নিয়ে অনেক আগে থেকেই প্রশ্ন উঠছিল। বিএসইসির অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, গ্রুপটির মোট ব্যাংকঋণ ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যার বড় অংশই এখন মন্দ ঋণে পরিণত। শুধুমাত্র বেক্সিমকো লিমিটেড-এর জুন ২০২৪ পর্যন্ত ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৩ হাজার ১০৯ কোটি এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৩ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস-এর ঋণের পরিমাণ ৬০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪২৬ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি এবং ১৭৫ কোটি টাকা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ।
শাইনপুকুর সিরামিকস-এর ঋণের পরিমাণ প্রায় ৯৮ কোটি টাকা। তবে রতনপুর ও নিউলাইন ক্লোথিংসের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও জটিল। দুই কোম্পানিই ২০২১ সালের পর স্টক এক্সচেঞ্জে কোনো আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। তবুও তাদের বিপুল ঋণের দায় রয়েছে—রতনপুরের ঋণ প্রায় ১৯৩ কোটি টাকা, আর নিউলাইন ক্লোথিংস-এর ঋণ ৯১ কোটি টাকা।
বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে কঠোর নজরদারি
এই পাঁচ কোম্পানির আর্থিক কার্যক্রমে সুশাসন নিশ্চিত না হওয়ায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিএসইসি মনে করছে, দীর্ঘমেয়াদে বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং কোম্পানিগুলোর দায়বদ্ধতা বাড়াতে এই তদন্ত সময়োপযোগী। একই সঙ্গে এটি অন্য কোম্পানিগুলোর জন্যও সতর্কবার্তা হয়ে থাকবে।
বিনিয়োগকারীদের অর্থ ও আস্থার সুরক্ষায় বিএসইসির এই পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তবে তদন্তের ফলাফল ও পরবর্তী পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে কোম্পানিগুলোর ভবিষ্যৎ এবং বাজারে এর প্রভাব কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে।
(সংবাদের ভিত্তি: বিএসইসির তদন্ত আদেশ, স্টক এক্সচেঞ্জ তথ্য এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন)