ঢাকা   বুধবার ১৮ জুন ২০২৫, ৪ আষাঢ় ১৪৩২

১০ ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ ৩ লাখ কোটি টাকা, ব্যাংকিং খাত ঘিরে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

অর্থ ও বাণিজ্য

শেয়ারবিজনেস ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭:৫৬, ১৮ জুন ২০২৫

১০ ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ ৩ লাখ কোটি টাকা, ব্যাংকিং খাত ঘিরে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে অনিয়ন্ত্রিত খেলাপি ঋণ, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ঋণগ্রহণের অপসংস্কৃতি এবং দুর্বল তদারকির কারণে পুরো খাতটি এখন চরম ঝুঁকির মুখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। এ বিশাল অঙ্কের মধ্যে মাত্র ১০টি ব্যাংকেই রয়েছে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, একক কিছু গ্রাহকগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের অনৈতিক প্রভাব, ভুয়া প্রতিষ্ঠান ও নামে-বেনামে ঋণ বিতরণ এবং ‘ঋণ নাও, ফেরত দিও না’ সংস্কৃতি পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে। পূর্বের নিয়মে অর্থ ফেরত না দিয়েও ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুযোগ বন্ধ হওয়ায় এখন খেলাপির প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে।

খেলাপির পরিমাণ বিবেচনায় শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির ৯৪ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৭০ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকাই এখন খেলাপি, যা মোট ঋণের ৭৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ২৪ হাজার কোটি ও এস আলম গ্রুপের ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এছাড়া ক্রিসেন্ট, অ্যানটেক্স, বিসমিল্লাহসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতিও ঘটেছে এই ব্যাংকে।

দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, যার খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৭ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা (২৭.৩৮%)। তৃতীয় অবস্থানে অগ্রণী ব্যাংক (২৯,৭২১ কোটি, ৪১.৪১%), চতুর্থ অবস্থানে ন্যাশনাল ব্যাংক (২৭,৩৫২ কোটি, ৬৪.০৩%) এবং পঞ্চম স্থানে আইএফআইসি ব্যাংক (২৫,৭৯১ কোটি, ৫৮.৩৯%)। এস আলমের নিয়ন্ত্রিত ইউনিয়ন ব্যাংক (২৫,৩০৩ কোটি, ৮৯.৮১%) ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকও (২২,৬৪৬ কোটি, ৩৬.৬৩%) শীর্ষ তালিকায় রয়েছে।

হলমার্ক কেলেঙ্কারির জন্য আলোচিত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ১৯ হাজার ৯১ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ১৭ হাজার ১২৩ কোটি এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা খেলাপি অবস্থায় রয়েছে। তবে অনুপাত বিবেচনায় ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের প্রায় সব ঋণই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, চৌধুরী নাফিজ, আব্দুল হাই বাচ্চু ও এস আলমের প্রভাবিত ব্যাংকগুলোতেও খেলাপির হার অস্বাভাবিকভাবে বেশি। পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ৮৭.১৮%, বেসিক ব্যাংকে ৬৯.৩৪% এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ৬৭% ছাড়িয়ে গেছে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। তখন থেকে নানা রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন ও ঋণ নিয়মিত দেখানোর সুবিধা দেওয়া হয়, যা পরিস্থিতিকে আজকের এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে।

অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ বার্তা
খেলাপি ঋণের এই চিত্র কেবল ব্যাংক খাত নয়, গোটা অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ। এতে নতুন বিনিয়োগে তারল্য সংকুচিত হচ্ছে, আমানতকারীদের আস্থা কমছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়ে সরকারের বাজেটেও অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত একটি কঠোর ব্যাংক তদারকি কাঠামো এবং খেলাপি আদায়ে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ। না হলে পুরো আর্থিক খাতের ওপর আস্থা হারাবে জনগণ, আর তা হবে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ংকর সংকেত।