ঢাকা   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

অবৈধভাবে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজারের কোম্পানির ৩ মালিক পালিয়েছে

শেয়ারবাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১১:২১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

আপডেট: ১১:২৬, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

অবৈধভাবে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজারের কোম্পানির ৩ মালিক পালিয়েছে

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির চার বছরের মধ্যে ফ্যামিলিটেক্সের পাঁচ উদ্যোক্তা-পরিচালকের তিনজন শতভাগ শেয়ার বিক্রি করে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই তিনজন কোম্পানির সঙ্গে সংশ্নিষ্টতা তো দূরের কথা, তাদের হদিসও মিলছে না। বাকি দু`জন মালিকানায় থাকলেও বেশিরভাগ শেয়ার বিক্রি করেছেন। এ ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি মানেননি কেউই।

অনুসন্ধানে ঘোষণা ছাড়া এবং লকইন পিরিয়ডে (আইপিও পরবর্তী শেয়ার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়) শেয়ার বিক্রির তথ্য উঠে এসেছে। অবৈধভাবে বিক্রি ঠেকানোর দায়িত্বে থাকা শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকেও (ডিএসই ও সিএসই) পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

এমনকি তিন উদ্যোক্তা-পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ ও তার স্ত্রী রোকসানা মোরশেদ এবং জুন কিয়ং উনের শেয়ার বিক্রির পরও বছরের পর বছর কোম্পানিটির শেয়ার ধারণের ভুল পরিসংখ্যান ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে স্টক এক্সচেঞ্জ দুটি। এ তথ্যকে সঠিক জেনেই ফ্যামিলিটেক্সের শেয়ারে এতদিন বিনিয়োগ করেছেন সাধারণরা। চলতি মাসে এ প্রথম কোম্পানিটি উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার না থাকার তথ্য প্রকাশ করে। হুট করে শেয়ার সংখ্যা কমে যাওয়ার তথ্য নজরে আসে। এরপর চমকে দেওয়ার মতো তথ্য জানা যায়।

ডিএসইর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে ছিল মোট শেয়ারের ২২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এক মাসের ব্যবধানে ৩১ জানুয়ারিতে তা নেমে আসে মাত্র ৪ শতাংশে। এ হিসাব করলে জানুয়ারিতে সাড়ে ১৮ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেছেন তারা। আসলে ওই মাসে বিক্রি হয়নি; বিপুল এ শেয়ার বিক্রি হয়েছে আরও এক থেকে আড়াই বছর আগে। এ ক্ষেত্রে বিক্রির ঘোষণা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা মানা হয়নি।

মূল্য সংবেদনশীল তথ্যটি এতদিন গোপন রাখা হয়। বার্ষিক হিসাব বিবরণী নিরীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানও তা দেখেনি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, তালিকাভুক্তির দু`বছর পর ২০১৫ সাল থেকে শেয়ার বিক্রি শুরু করেছেন তারা। ২০১৭ মধ্যে নিজেদের ৪১ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করেন মালিকরা। এর মধ্যে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ ২০১৫ সালের ৩১ মে থেকে ১৫ জুনের মধ্যে এক কোটি ৯৮ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন। পরের শেয়ার বিক্রিতে আর কোনো ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করেননি। এ নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো প্রশ্ন না তোলায় তিনি ও অন্যরা একই পথ অনুসরণ করে বিনা ঘোষণায় বাকি প্রায় ১১ কোটি শেয়ার বিক্রি করেন। ওই সময় এ শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১৫ টাকা। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার ফ্যামিলিটেক্সের দর ছিল ৪ টাকা ৯০ পয়সা।

কোম্পানিটির শেয়ার ধারণের মাসিক প্রতিবেদনগুলো পরীক্ষায় দেখা গেছে, এগুলোর শুরুর তথ্যের সঙ্গে পরের অংশের উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার ধারণের তথ্যে বৈপরীত্য সুস্পষ্ট ছিল। যেমন গত ডিসেম্বর শেষে শেয়ার ধারণের তথ্যে শুরুতে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ২২ দশমিক ৪৩ শতাংশ রয়েছে বলে উল্লেখ আছে; কিন্তু নিচের অংশে দেখানো হয় দুই পরিচালকের শেয়ার আছে মাত্র ৪ শতাংশ। ২০১৬ সাল থেকে প্রতি মাসে এমন ভুল তথ্য দেয় কোম্পানিটি।

প্রতিবেদনগুলো প্রতি মাসে পেলেও বিএসইসির কর্মকর্তাদের চোখে তা ধরা পড়েনি। এমনকি স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তারাও তা দেখেননি। গত সপ্তাহে সমকালের পক্ষ থেকে অনুসন্ধানে সময় বিষয়টি নজরে আসে তাদের।

মাসিক শেয়ার ধারণের তথ্য এবং বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আইপিও অনুমোদনের সময় ফ্যামিলিটেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদের শেয়ার ছিল দুই কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার। তালিকাভুক্তির পরই কোম্পানি ১০০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিলে তার শেয়ার বেড়ে দ্বিগুণ (৪ কোটি ৭৬ লাখ) হয়। প্রথমবার ২০১৫ সালের ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত মাত্র ১৬ দিনে এক কোটি ৯৮ লাখ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে কোনো ঘোষণা ছাড়াই প্রায় তিন কোটি শেয়ারের পুরোটা বিক্রি করেন। এখন তার একটিও শেয়ার নেই।

ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চেয়েও বড় অনিয়ম করেছেন আরেক উদ্যোক্তা কোরিয়ান নাগরিক জুন কিয়ং উন। তিনি ২০১৪ সালের ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ারসহ চার কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার শেয়ারের পুরোটা ২০১৫ সালেই অর্থাৎ আইপিওতে আসার দুই বছরের মাথায় ঘোষণা ছাড়া বিক্রি করেন। এখন তারও কোনো শেয়ার নেই। আইপিও অনুমোদনের পর তার শেয়ারে লকইন ছিল ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

একই পথ অনুসরণ করেন সাবেক চেয়ারম্যান রোকসানা মোরশেদ। আইপিও অনুমোদনের সময় তার শেয়ার ছিল ৪০ লাখ। পরের তিন বছরে বোনাস লভ্যাংশের কারণে মোট শেয়ার ৯২ লাখ ৪০ হাজারে উন্নীত হয়। পুরোটাই বিক্রি করেন ২০১৬ সালে। তবে এখনও মালিকপক্ষের দু`জনের অল্প শেয়ার রয়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যান মেরাজ-ই-মুস্তফার আইপিও অনুমোদনের সময় শেয়ার ছিল এক কোটি। বোনাস লভ্যাংশের কারণে ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে তা সোয়া দুই কোটিতে উন্নীত হয়। তিনিও নিজের দুই-তৃতীয়াংশ শেয়ার বিক্রি করেন। বর্তমানে তার আছে ৭১ লাখ ১১ হাজার শেয়ার। সবচেয়ে কম শেয়ার বিক্রি করেছেন তাবাস্‌সুম করিম। আইপিওতে আসার সময় তার শেয়ার ছিল ৪০ লাখ। ২০১৬ সালে তিনিও ঘোষণা ছাড়া বিক্রি করেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে আইপিওর সময় উদ্যোক্তা-পরিচালকদের মালিকানায় ছিল ৪৫ দশমিক ১৬ শতাংশ শেয়ার। পর্যায়ক্রমে তা মাত্র ৪ দশমিক ০২ শতাংশে নেমেছে।

সাবেক চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং উদ্যোক্তা জুন কিয়ং উনেরও হদিস নেই। বর্তমান চেয়ারম্যানকে ফোন করা হলেও সাড়া দেননি। জানতে চাইলে ফ্যামিলিটেক্সের কোম্পানি সচিব বলেন, কোম্পানির পরিচালকরা তাদের শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব পর্ষদ সভায় তুললেও তা অনুমোদন হয়নি। পরে নিজ দায়িত্বে বিক্রি করেছেন। এর দায় কোম্পানির নয়।