
দেশের ব্যাংক খাতে গ্রাহকের আমানত হিসাব দ্রুত বাড়লেও, ঋণ হিসাব সে হারে বাড়ছে না—বরং ঋণের গতি কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে আমানত হিসাব বেড়েছে ২৪ লাখ ৫৯ হাজার ২৮৯টি, যেখানে ঋণ হিসাব বেড়েছে মাত্র ৫ লাখ ১৫ হাজার ৪২১টি—অর্থাৎ আমানত হিসাব বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি।
এই তিন মাসে গড়ে প্রতিদিন ২৭ হাজারের বেশি নতুন ব্যাংক হিসাব খোলা হলেও ঋণ হিসাব খোলার সংখ্যা অনেক কম। মার্চের শেষে ব্যাংকে মোট গ্রাহক হিসাব দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৫৭ লাখেরও বেশি। অন্যদিকে মোট ঋণ হিসাবের সংখ্যা মাত্র ১ কোটি ৩৪ লাখ। অর্থাৎ ব্যাংকে জমা পড়া টাকার বড় অংশ ছড়িয়ে আছে বহু মানুষের মাঝে, কিন্তু ঋণ চলে যাচ্ছে হাতে গোনা কয়েকজনের হাতে। বিশ্লেষকদের মতে, এ চিত্র একটি গভীর বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৯ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকায়, যেখানে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। মাথাপিছু হিসাবে দেখা যাচ্ছে, আমানত বেড়েছে ৬৮৯ টাকা, অথচ ঋণ কমেছে প্রায় ২৮ হাজার টাকা। এ থেকে বোঝা যায়, ব্যাংকে মানুষ টাকার সঞ্চয় বাড়াচ্ছে, কিন্তু ঋণ নিতে আগ্রহ কমছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের অর্থনৈতিক মন্দাভাব, নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং উদ্যোক্তাদের ঝুঁকি না নেওয়ার প্রবণতা এর অন্যতম কারণ। ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে টানা ছয় মাস ধরে ঋণের প্রবৃদ্ধি আট শতাংশের নিচে রয়ে গেছে।
গবেষণা সংস্থা সিপিডির পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, যাদের নামে একাধিক হিসাব রয়েছে, তাদের হিসাবও গ্রাহক হিসাবে গণনা করা হয়েছে। ফলে মাথাপিছু আমানতের পরিসংখ্যান বিভ্রান্তিকর হতে পারে। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—সব ঋণ এক কোটি ৩৪ লাখ হিসাবধারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ, যেখানে আমানতকারীর সংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। অর্থাৎ দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ টাকা রাখছেন, কিন্তু ঋণ পাচ্ছেন অল্প কয়েকজন।
এ বৈষম্য শহর-গ্রাম বিভাজনেও স্পষ্ট। মার্চ পর্যন্ত শহরাঞ্চলে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যেখানে গ্রামাঞ্চলে মাত্র ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে শহরাঞ্চল থেকেই এসেছে ব্যাংক আমানতের ৮৫ শতাংশের বেশি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ এবং নীতিগত বৈষম্যের কারণেই এই চিত্র তৈরি হয়েছে।
সিপিডি আরও জানিয়েছে, দেশের অর্ধেক জনগণ এখনো ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে রয়েছে। আয় বাড়লেও ব্যাংক অ্যাক্সেস না পাওয়ার কারণে তারা এই খাতের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে দেশে ব্যাংক ব্যবস্থার বিস্তার এবং ঋণ বিতরণে ভারসাম্য তৈরি এখন সময়ের দাবি।