
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের চাপ মোকাবিলায় এবারের বাজেটে ১১০টি পণ্যে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করেছে বাংলাদেশ। সরকারের লক্ষ্য, এই শুল্ক ছাড়ের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতি কমানো এবং আলোচনার টেবিলে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করা। তবে বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীদের অভিমত, শুধু শুল্ক প্রত্যাহারেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ার সম্ভাবনা খুবই সীমিত।
অর্থ উপদেষ্টা বাজেট বক্তৃতায় জানান, ১১০টি পণ্যে আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের পাশাপাশি ৬৫টি পণ্যে শুল্ক কমানো হয়েছে। যদিও বাস্তবে দেখা যায়, কাস্টমস ও নির্দিষ্ট শুল্ক মিলিয়ে শুল্কছাড়ের আওতায় এসেছে ১১০টি পণ্য, যার মধ্যে অনেক পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয় না। এসব সুবিধা সব দেশ থেকেই আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ২,৫১৫টি এইচএস কোডভুক্ত পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রড উৎপাদনের কাঁচামাল—পুরোনো লোহার টুকরো (স্ক্র্যাপ)। আগে টনপ্রতি দেড় হাজার টাকা শুল্ক থাকলেও এবারে তা তুলে দেওয়া হয়েছে। যদিও এই খাতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ মাত্র ৩৬ শতাংশ, বাকি ৬৪ শতাংশ আসে অন্যান্য ৫০টি দেশ থেকে।
আরেকটি বড় আমদানি পণ্য সয়াবিনবীজ—যার ওপর আগে থেকেই কোনো শুল্ক নেই। গত বছর ব্রাজিল থেকে এসেছে মোট ৯৪ কোটি ডলারের মধ্যে ৫৬ কোটি ডলারের সয়াবিনবীজ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ৩২ কোটি ডলারের। ফলে সয়াবিনবীজ আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব থাকলেও, শুল্কছাড়ের কারণে আমদানি বাড়বে এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল বলেন, কাঁচামাল ও প্রস্তুত পণ্যে যদি একই শুল্ক থাকে, তাহলে দেশীয় শিল্প টিকবে না। সয়ামিলের মতো প্রস্তুত পণ্যে শুল্ক আরোপ করলে কাঁচামাল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিনবীজ আমদানি বাড়তে পারত, আর দেশীয় উৎপাদনকারীরাও চাঙ্গা হতো।
এছাড়া গ্যাস টারবাইন, উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ, অগ্নিনিরাপত্তা সরঞ্জাম, সুতা, সিনথেটিক ফাইবারসহ আরও কিছু পণ্যে ১ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এসব পণ্যের আমদানির বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে হয় না। ফলে এই শুল্কছাড় যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক আমদানিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবে না।
ব্যবসায়ীরা আরও জানান, দূরত্ব ও পরিবহন খরচের কারণে চীন ও ভারত থেকে পণ্য আমদানি তুলনামূলক সাশ্রয়ী। যদিও কিছু উন্নতমানের পণ্য আমদানির জন্য যুক্তরাষ্ট্র নির্ভরতা থাকে, তবে তা সীমিত পরিসরে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ২৯১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা মোট আমদানির তুলনায় তুলনামূলক কম।
সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুল্কছাড় সব দেশকে দিলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাদের বাড়তি সুবিধা থাকে না। শুল্ক ছাড়ের মাধ্যমে শুল্ক উদারীকরণের বার্তা দেওয়া গেলেও আলোচনার আগেই এই ছাড় দেওয়ায় দর–কষাকষির সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমদানির ভারসাম্য আনতে হলে কৌশলগত আলোচনাই হবে মূল চাবিকাঠি।
শুল্ক প্রত্যাহার মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর একটি কৌশল হলেও বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এই উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে না। বরং পণ্য নির্বাচন ও আলোচনার কৌশলে আরও সুচিন্তিত পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।