
সম্প্রতি বকেয়া পারিশ্রমিকের বিষয়টি সামনে এনেছেন অভিনেত্রী ডলি জহুর। ঢালিউড প্রযোজকদের কাছে পারিশ্রমিক বাবদ ৩৪ লাখ টাকা পাওনা তাঁর। মনঃক্ষুণ্ন হয়ে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, তাঁর স্বামীর ক্যানসারের চিকিৎসার সময়েও তিনি পরিচালক–প্রযোজকের কাছে পাওনা টাকা চেয়েও পাননি।
এমনকি পারিশ্রমিকের পাওনা টাকার জন্য কান্নাও করতে হয়েছে এই অভিনেত্রীকে। বকেয়া পারিশ্রমিক নিয়ে এ ঘটনা নতুন নয়। প্রয়োজনের সময় পারিশ্রমিকের টাকা পাননি অনেক অভিনয়শিল্পী। তাঁদের অনেকে প্রয়াতও হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে প্রয়াত শিল্পীর পরিবারের কেউই পাওনা টাকা পাননি; বরং পরিচিতজনদের অচেনা হতে দেখেছেন।
অভিনেতা আবুল হায়াত জানান, সিনেমায় নিয়মিত অভিনয় করার সময়ে অনেক কাজের পারিশ্রমিক বকেয়া পড়েছিল। সেগুলো অনেকবার চেয়েছিলেন। কিন্তু পরে পারিশ্রমিক না পেয়ে আর চাননি। সেগুলো নিয়ে আর কথাও বলতে চান না এই অভিনেতা। তিনি মনে করেন, সম্মানীর সঙ্গে তো সম্মান জড়িত। সেখানে কেউ পারিশ্রমিকের সম্মানী না দেওয়ার অর্থ হলো, অসম্মান করা। শিল্পী হিসেবে এটা মানতে না পেরে পরে অনেকের কাছে সম্মানী চাননি তিনি।
আবুল হায়াত বলেন, ‘আমার সঙ্গে এটা কম হয়। শুধু সিনেমায় নিয়মিত কাজ করার সময়ে হয়েছে। আগের কথা আর বলতে চাই না। তবে প্রায়ই শুনি, যাঁরা কম পারিশ্রমিক পান, তাঁরা অনেকেই ঠিকমতো পারিশ্রমিক পান না। আমি নাটক নির্মাণ ও প্রযোজনা শুরুর পরে নিয়মিত চর্চা করেছি সবার পারিশ্রমিক ঠিকমতো পরিশোধ করতে। কেউ বলতে পারবেন না যে আমার কাছে পারিশ্রমিক পান। শুটিং শেষ, সবার সম্মানীর খাম রেডি থাকত। কখনো প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা না পেলেও নিজের টাকায় পারিশ্রমিক দিয়ে দিতাম। গত সরকারের আমলের একটি টেলিভিশন বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের কাছে আমার পাওনা আছে। এখন কার কাছে চাইব। পারিশ্রমিক বকেয়া রাখার চর্চাটাই বন্ধ হওয়া উচিত।’
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সব সময় নিজ থেকে কাজের জায়গায় স্বচ্ছতা বজায় রেখেছেন বলে জানালেন কাজী হায়াৎ। তবে নিজে অনেক সময়ই বঞ্চিত হয়েছেন। এ নিয়ে কষ্ট থাকলেও কারও কাছে কোনো অভিযোগ নেই। কাজী হায়াৎ বলেন, ‘দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। অভিনেতা হিসেবে আমার পারিশ্রমিক তেমন কারও কাছে বকেয়া নেই। যা আছে বলতে চাই না। তবে পরিচালক হিসেবে আমি অনেক ঠকেছি। অনেকেই আমাকে ঠকিয়েছেন। এগুলো এখন আর বলতে চাই না। কোনো অভিযোগ ও অনুযোগ নেই। তাঁদের অনেকেই দুনিয়া ছেড়েছেন। কেউ কেউ এখন আর কাজ করেন না। তাঁদের কাউকে আমি খারাপ বলব না। সবাই ভালো। আমার ভাগ্যে যেটা ছিল, সেটাই হয়েছে।’
পারিশ্রমিক নিয়ে কমবেশি অভিনয়শিল্পীদের সবাইকেই বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে। এর আগে গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতা দিলদারের বড় মেয়ে মাসুমা আক্তার জানান, ঢালিউড প্রযোজকদের কাছে তাঁর বাবার পাওনা ছিল ৮০ লাখ টাকার বেশি। তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পরে কেউই পারিশ্রমিকের অর্থ পরিশোধ করেনি। এমনকি মিডিয়ার অনেকে তাঁদের সঙ্গে আগের মতো সম্পর্কও বজায় রাখেননি। প্রয়োজনের সময়ে দিলদার কারও কাছেই সহায়তা পাননি।
আরেক প্রয়াত অভিনেতা মিজু আহমেদও অনেকের কাছে পারিশ্রমিকের অর্থ পেতেন। সেগুলো নির্দিষ্ট করে না জানার কারণে কারও কাছেই এই পরিবারের দাবিদাওয়া নেই। মিজু আহমেদের মেয়ে কেয়া আহমেদ জানান, তাঁর বাবা মিডিয়া অঙ্গনের কোনো কথাই পরিবারের সঙ্গে ভাগাভাগি করতেন না। যতটুকু তাঁরা পরে জানতে পেরেছিলেন, এই অভিনেতা বেশ কিছু প্রযোজকের কাছে পারিশ্রমিক পেতেন। কেয়া বলেন, ‘বাবা যেহেতু কিছু বলে যাননি, সেগুলো নিয়ে আমাদের কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই। তবে বাবা যে শুটিংয়ে যাচ্ছিলেন, সেই শুটিংয়ের সাইনিং মানি আমরা বাবা মারা যাওয়ার পরপরই পরিশোধ করেছি। আমাদের দাবিদাওয়া নেই।’
আরেক ঢালিউড অভিনেতা জ্যাকি আলমগীরের ঢালিউডে ক্যারিয়ার তিন দশকের বেশি সময়ের। একসময় নিয়মিত কাজ করতে গিয়ে অনেকের কাছে পারিশ্রমিক বকেয়া পড়ে। তিনি বলেন, ‘বেশ আগের বেশ কিছু কাজের পারিশ্রমিক বকেয়া রয়েছে। সেগুলো নিয়ে এখন আর কথা বলতে চাই না। যারা দেয়নি, তো দেয়নি। পারিশ্রমিক কয়েকজনের কাছে পাব। সেগুলো নিয়ে কোনো দাবিদাওয়া নেই। এগুলো এখনকার তুলনায় খুব বেশি হবেও না। হয়তো কয়েক লাখ টাকা।’
শুধু অভিনয়শিল্পী নন, কলাকুশলীরাও অনেকেই পরিচালক–প্রযোজকদের কাছে পারিশ্রমিক পান। এর আগে সিমিত রায় ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, তিনিও ঢালিউডের একাধিক প্রযোজকের কাছে সম্পাদনা করার পারিশ্রমিক পান। জরুরি প্রয়োজনেও তিনি বারবার সেই অর্থ চেয়ে পাননি। পরে বাধ্য হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন।
শুধু সিনেমাতেই নয়, নাটকের পারিশ্রমিকও অনেকের লাখ লাখ টাকা বকেয়া। সময়ের জনপ্রিয় এক অভিনেত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এগুলো নিয়ে কী আর বলব। দেড় বছর ধরে শুধু দুজন পরিচালকই ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিচ্ছেন না। সর্বশেষ এ সপ্তাহে তাঁদের দেওয়ার কথা। এমন আরও অনেকের কাছে পাই। অনেকেই বলে দেবেন, কিন্তু কথা রাখেন না। টাকাপয়সা নিয়ে মিডিয়ার কাউকে বিশ্বাসই করা যায় না। একজনের গত ৩১ তারিখ দেওয়ার কথা ছিল, এখন যোগাযোগই করছে না।’
অভিনয়শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ মামুন অপু বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরে বেশ কয়েকজন পারিশ্রমিক নিয়ে অভিযোগ করেছিলেন। সেগুলো নিয়ে আমরা কথা বলেছি। মিটমাট করার চেষ্টা করেছি। কেউ কেউ বারবার কথার বরখেলাপ করেছেন। সেগুলো নিয়ে আমরা শক্ত অবস্থানে যাচ্ছি। আমরা মনে করি, শিল্পীদের সম্মান রক্ষার্থে সম্মানীটা কাজ শেষের পরে দিয়ে দেওয়া হোক। এটা না হওয়ায় অনেক শিল্পীই অসম্মানিত হচ্ছেন।’