
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ)–এর ১০ শিক্ষার্থীকে প্রতিবছর ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি দেয় প্রথম আলো ও আইডিএলসি। শুধু এটিই নয়, সুবিধাবঞ্চিত আরও বহু নারীকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে চট্টগ্রামের এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেমন ‘তৈরি পোশাকশিল্প’ খাত থেকে এ পর্যন্ত ১২৩ জন আন্তর্জাতিক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একজন সাদিকা বেগম। হাজারো বাধা পেরিয়ে সাফল্যের দেখা পাওয়া এই নারীর কথা নিশ্চয়ই আরও অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হবে।
কী সুন্দর একটা গোছানো সংসার ছিল আমাদের! বাবা ছিলেন কাঠমিস্ত্রি, কৃষিকাজও করতেন। একবার প্যারাস্যুট সুতা দিয়ে এত সুন্দর একটা সোফা বানিয়েছিলেন, আশপাশের গ্রাম থেকেও লোকে দেখতে এসেছিল। বড় বড় নৌকা বানাতেন। সেগুলো ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায়ও বিক্রি হতো। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে আমাদের নিজেদের জমি, জায়গা, ভিটাবাড়ি সব ছিল।
আমরা ছয় ভাইবোন। বড় বোনের তখন বিয়ে হয়ে গেছে। আমি উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে, আমার পরের বোন প্রথম বর্ষে। বাকি তিন ভাই-বোন অনেক ছোট। এ রকম একটা সময়ে, ২০১৫ সালে বাবার স্ট্রোক করল। তারপর চলাফেরা করতে পারতেন; কিন্তু কোনো কাজ করার শক্তি পেতেন না। হুট করেই আমরা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়লাম।
জমানো যা টাকা ছিল, তার একটা বড় অংশ বাবার চিকিৎসায় খরচ হয়ে গেল। সাতজনের পরিবার। বসে বসে খেলে আর কত দিন চলে? কিছুদিনের মধ্যেই আমরা ভীষণ অর্থ সংকটে পড়লাম। সেই সময়ে এগিয়ে এলেন আমার মামারা।
এক মামা আর মামাতো ভাই গ্রিসে থাকতেন। তাঁরা প্রতি মাসে চাল, ডাল ও তেল কেনার টাকা দিতেন। আরেক মামা মাসের শুরুতেই বাজার করে দিয়ে যেতেন। সেই মামাই কথাটা প্রথম তুললেন, ‘বাড়ির দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়? সংসারটাও তাহলে অনেকটাই “হালকা” হয়ে যাবে।’ তিনি বোঝালেন, খাওয়ার চেয়েও বড় খরচ পড়াশোনা। সেটি চালানোর মতো অবস্থা আমাদের পরিবারের নেই। অসুস্থ বাবা তখনো বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলতেন, ‘সাদিকা যেদিন পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবে, সেদিন আমি সুস্থ হব।’
বুঝে গেলাম, নিজের পড়াশোনার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। উচ্চমাধ্যমিকের পর যে কয়েক মাস সময় হাতে থাকে, ভাবলাম এর মধ্যে চাকরি করে টাকা জমাব। যেন ওই টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারি। আমি ঢাকায় যাব শুনে ছোট বোনটা বলল, সে-ও সঙ্গে যাবে। এরপর বাবা জানিয়ে দিলেন, তিনিও যাবেন।
২০১৫ সালের আগস্টে আমরা তিনজন গাঁটরিবোঁচকা বেঁধে ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকায় আমাদের গ্রামের এক প্রতিবেশী থাকেন, তাঁর স্ত্রী আবার গার্মেন্টসে চাকরি করেন। ঢাকায় পৌঁছে পরদিনই আমরা তাঁর সঙ্গে গার্মেন্টসে গেলাম। একে তো লম্বা যাত্রার ধকল তখনো কাটেনি, তার ওপর গার্মেন্টসের পরিবেশ দেখেই আমার ছোট বোন জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। টানা ২২ দিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল ও। আমি অবশ্য প্রথম দিন থেকেই সুইং সেকশনে চাকরি শুরু করি। আমার বোন শুরু করে ২৫ দিন পর। জানিয়ে রাখি, আমার সেই বোন এখন পুলিশে চাকরি করে।
তিন মাস গার্মেন্টসে কাজ করেছি। কীভাবে যে এই কটা দিন টিকে গেছি, এখন ভাবলে অবাক লাগে। কর্মী হিসেবে কোনো সম্মান নেই। অযথা গালাগাল, চিৎকার, অপমান, সহকর্মীর টিপ্পনী, এসবই আমার জন্য ট্রমা ছিল। ওই তিন মাসে প্রতিটা দিন বাসায় ফিরে কাঁদতাম। বালিশে চোখের পানির দাগ হয়ে গিয়েছিল।
প্রথম মাসের বেতনের টাকা নিয়ে একা একা টঙ্গী চলে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার গাইড কিনলাম। ঢাকায় গ্রামের যে প্রতিবেশীর বাড়িতে উঠেছিলাম, তিনি বাড়িতে ফোন করে বলেছিলেন, আমি নাকি উচ্ছন্নে গেছি। একা একা টঙ্গী গেছি। আমি বেয়াদব। খারাপ মেয়ে। গ্রামের পরিবেশ তো বোঝেন। মুহূর্তে এ কথা ডালপালা ছাড়িয়ে রটে গেল। লোকজন আমার মাকে এসে কথা শোনাতে লাগল। সেই দিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যত দ্রুত সম্ভব এই পরিবেশ থেকে বের হব। আমার পরিবারকেও বের করব।
সারা দিন গার্মেন্টসে কাজ করে বাসায় ফিরে গাইড খুলে দেখতাম, কিছুই পারি না, বুঝি না। আমার আসলে কোচিং বা প্রাইভেট টিউটরের খুব দরকার ছিল। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়, কিছুই জানতাম না, বুঝতাম না। একেকজন একেক রকম কথা বলছিল। আসলে ওদেরও তো তেমন ধারণা ছিল না।
মাসখানেক পর এইউডব্লিউর বৃত্তির খোঁজ নিয়ে একটা দল এল। মনে হলো, আমাকে উদ্ধার করতেই ওরা এসেছে। আমার গার্মেন্টসে আমি প্রথম হলাম। সবাই নানা কটু কথা বলেছিল। আমি কিচ্ছু শুনিনি। আমার কানেই ঢোকেনি। আমি নিশ্চিত ছিলাম, দিন-রাত কান্নাকাটি করে খোদার কাছে যে দোয়া করতাম—সেটিরই উত্তর তিনি দিয়েছেন।
ভর্তি হয়ে গেলাম ২০১৬ সালে। স্নাতকের পড়াশোনার আগে এইউডব্লিউতে দুই বছরের কিছু প্রাথমিক কোর্স করতে হয়। সেখানে ইংরেজি থেকে শুরু করে আদবকেতা, যোগাযোগ, নানা কিছু শেখানো হয়। ওই প্রোগ্রাম আমি তিন মাসে শেষ করেছিলাম। মক টেস্টে এত ভালো করেছিলাম যে বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে উত্তীর্ণ বলে গণ্য করেছিল।
শুরু হলো স্নাতকের পড়াশোনা। প্রথম বর্ষেই ‘দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা’ নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেটি স্পেনের বার্সেলোনার ওয়েস্ট ইস্ট ইনস্টিটিউটে গৃহীত হলো। রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট ও টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে সুযোগ পেয়ে গেলাম। আমার মতো প্রত্যন্ত গ্রাম, গার্মেন্টস, শরণার্থীশিবির বা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে আসা মেয়েদের যেন ইংরেজি নিয়ে সমস্যায় পড়তে না হয়, সে জন্য ইংলিশ স্পিকিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন ক্লাব খুলে ফেললাম। সর্বোচ্চ রেজাল্ট নিয়ে ২০২০ সালের ‘ভ্যালিডিক্টোরিয়ান’ হিসেবে স্নাতক করে বের হলাম। ২০২৩ সালের মার্চে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ফান্ড রাইজিং প্রোগ্রামে মূল বক্তা হিসেবে জাপানে গিয়েছিলাম।
২০২১ সালের মে মাসে ইউনিসেফে চাকরি পাই। বাবার শারীরিক অবস্থাও তখন থেকেই ভালো হতে শুরু করে। যেমনটা বাবা সব সময় বলতেন। অনেক দিন তিনি বেশ ভালোই ছিলেন। সম্প্রতি মারা গেছেন। তিনি দেখে যেতে পেরেছেন যে আমরা সবাই কম-বেশি জীবনে ভালো করছি, নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছি। এটুকুই যা সান্ত্বনা।
২০২১ সালের শেষের দিকে আমি আইপিডিসিতে চাকরি পাই। আইপিডিসির নারীদের আর্থিক পরিষেবামূলক প্ল্যাটফর্ম আইপিডিসি প্রীতিতে এখন প্রোডাক্ট ও মার্কেটিং নিয়ে কাজ করছি। তবে আমি জানি, আমার আরও অনেক কিছু করার আছে, অনেক দূরে যাওয়ার আছে।