ঢাকা   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

আঙ্করভাটে এক ভোরের রূপকথা — অষ্টম আশ্চর্যের অন্তর্জগতে

ভ্রমণ

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৯:২৮, ৩ মে ২০২৫

আঙ্করভাটে এক ভোরের রূপকথা — অষ্টম আশ্চর্যের অন্তর্জগতে

কম্বোডিয়ার প্রাচীন নগরী সিয়েম রিপের এক ভোরবেলায় সূর্যোদয়ের আগেই আমাদের যাত্রা শুরু হয় সেই বিস্ময়কর স্থাপত্য-আশ্চর্য ‘আঙ্করভাট’-এর দিকে। নমপেন থেকে স্লিপার বাসে ছয় ঘণ্টার যাত্রায় পৌঁছাই সিয়েম রিপে, যেখানে আধো-আলো আধো-অন্ধকারে শহরটি যেন এক জাদুকরী রূপকথার বই থেকে উঠে আসা কোনো নগরী। সেন্টার হোটেলে রাত কাটিয়ে আমরা সকাল পাঁচটার কিছু পরেই রওনা দিই পৃথিবীর নবম বিস্ময়—আঙ্করভাটের উদ্দেশ্যে।

২০২৩ সালের নভেম্বরে ইউনেস্কো আঙ্করভাটকে ‘অষ্টম আশ্চর্য’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। রোমান শহর পম্পেইকে পেছনে ফেলে একে করা হয় ইতিহাস, শিল্প ও ধর্মের যুগপৎ সম্মেলনের এক অপূর্ব নিদর্শন। ২০০ হেক্টর বিস্তৃত এই মন্দির যেন খেমার রাজ্যের গর্ব, রাজা সূর্য বর্মণের স্থাপত্যবোধের শ্রেষ্ঠ প্রতিফলন।

মন্দিরে প্রবেশের জন্য ৩৭ ডলারের টিকিট কেটে আমরা পৌঁছাই তার প্রবেশপথে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই মন্দিরের পেছন থেকে সূর্য উদিত হতে দেখে মনে হয়, প্রকৃতি আর মানবসৃষ্টির অপূর্ব সংমিশ্রণ এ যেন। মন্দিরের প্রথম ধাপে মহাভারতের যুদ্ধদৃশ্য, ভীষ্মের শয্যা, অর্জুন ও কৃষ্ণের রথ, সমুদ্রমন্থনের কাহিনি আর সূক্ষ্ম কারুকার্যে ভরপুর অপ্সরার মূর্তিগুলো আমাদের স্তব্ধ করে দেয়।

তিন ধাপের এই মন্দিরের শেষ ধাপে উঠতে গিয়ে মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতা—“সেই সিঁড়ি ঘুরে প্রায় নীলিমার গায়ে গিয়ে লাগে…”। মন্দিরের গর্ভগৃহে আজ আর বিষ্ণুর মূর্তি নেই, বুদ্ধের প্রতিচ্ছবি তার জায়গা নিয়েছে; এক সময়কার হিন্দু মন্দির রূপ নিয়েছে বৌদ্ধ উপাসনালয়ে।

রাজা দ্বিতীয় সূর্য বর্মণের ২৮ বছরের শাসনকালে নির্মিত এই মন্দির তাঁর মৃত্যুর পর অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। পরে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবর্তনের ধারায় এটি বৌদ্ধ মন্দিরে রূপ নেয়। সপ্তম জয় বর্মণ যখন রাজধানী সরিয়ে নেন ও নতুন মন্দির নির্মাণ করেন, তখন আঙ্করভাট তার প্রাচীন কোলাহল হারায়—কিন্তু হারায়নি তার ঐতিহ্য।

মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় সূর্য তখন অস্তমিত হওয়ার পথে। রক্তিম আভায় মন্দিরের স্তম্ভ ও কারুকাজ যেন নতুন করে প্রাণ পায়। মনে হয়, এই প্রাচীন পথ ধরে হেঁটে গিয়েছেন রাজা সূর্য বর্মণ, আর আজ আমরা সেই ইতিহাসের স্পর্শে নিজেদের খুঁজে পাচ্ছি।

কম্বোডিয়া শুধু আঙ্করভাট নয়—রয়্যাল প্যালেস, কিলিং ফিল্ড, মেকং নদী থেকে শুরু করে নীল সমুদ্র, গহিন অরণ্য ও পাহাড়ে ভরপুর এক অনন্য গন্তব্য। সহজ ভিসা প্রক্রিয়া ও স্বল্প খরচে ভ্রমণের সুযোগ থাকায় এটি হতে পারে আপনার পরবর্তী ভ্রমণ তালিকার শীর্ষস্থান।

একদিন জীবনানন্দের মতো আমরাও যেন বলি, “একদিন সৃষ্টি পরিধি ঘিরে কেমন আশ্চর্য এক আভা দেখা গিয়েছিলো”—আঙ্করভাটের এক ভোরবেলায়।