২০২৫ সালের শুরুতেই দেশের ব্যাংকিং খাতে জমে থাকা সংকট পুরোপুরি প্রকাশ্যে আসে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব, ঋণ অনিয়ম, দুর্বল তদারকি ও লুটপাটের মাধ্যমে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল, তা আর গোপন রাখা সম্ভব হয়নি। বছরের পর বছর চাপা থাকা এই সংকট ২০২৫ সালে এসে রীতিমতো বিস্ফোরিত হয়েছে, যা ব্যাংকিং খাতকে নিয়ে এসেছে ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়ের মুখে।
ব্যাংকগুলোর আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ। এক বছরে এই অঙ্ক দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে, যা ২০০০ সালের পর সর্বোচ্চ। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে এক ডজনের বেশি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
বিশেষ করে ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বড় করপোরেট গ্রুপগুলোর খেলাপি হয়ে পড়া এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করে। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় নেওয়া বিপুল অঙ্কের ঋণ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ব্যাংকগুলোর মূলধন কার্যত ফাঁপা হয়ে যায়।
এই সংকটের মধ্যে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিও ছিল চাপে। মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের ঘরে থাকায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয় বেড়ে যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখায় ঋণের সুদহার বেড়ে দাঁড়ায় ১৬–১৭ শতাংশে। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে, বিনিয়োগ কমে যায় এবং আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে—নিজেদের জমানো টাকা আদৌ নিরাপদ কি না, তা নিয়ে।
একীভূতকরণ ও শেয়ার শূন্য ঘোষণা
বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল পাঁচটি সংকটাপন্ন ইসলামী ব্যাংক একীভূত করে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’ গঠন। ৩০ অক্টোবর লাইসেন্স পাওয়া এই ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন দাঁড়ায় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে সরকারের অংশ ২০ হাজার কোটি টাকা।
এই নতুন ব্যাংকের আওতায় আসে—
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক,
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক,
ইউনিয়ন ব্যাংক,
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক
এবং এক্সিম ব্যাংক।
একীভূতকরণের সময় ব্যাংক শাখাগুলোতে আমানতকারীদের ভিড়, নগদ উত্তোলনে ব্যর্থতা এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তা দেয়, তবু অনেক গ্রাহক সময়মতো টাকা তুলতে পারেননি।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দেয়—এই পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারমূল্য শূন্য। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের ৩৩ ধারায় শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানা কার্যত বাতিল করা হয়। ফলে কোটি কোটি টাকার শেয়ার রাতারাতি কাগুজে মূল্যে পরিণত হয় এবং বিনিয়োগকারীরা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হন।
আইনি সংস্কার, তবে প্রশ্ন রয়ে গেছে
এই সংকট সামাল দিতে সরকার দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাস করে—
ব্যাংক রেজোলিউশন অধ্যাদেশ ২০২৫, যার মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকে হস্তক্ষেপের ক্ষমতা পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আমানত সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৫, যেখানে আমানত বিমার সীমা ১ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা করা হয়—যা প্রায় ৯৩ শতাংশ আমানতকারীকে সুরক্ষা দেবে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার উদ্যোগ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্ত করার দাবি উঠলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
স্বস্তির খবর: বৈদেশিক খাত
সব সংকটের মাঝেও স্বস্তির খবর এসেছে বৈদেশিক খাত থেকে। হুন্ডি ও হাওলার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ায় ২০২৪–২৫ অর্থবছরে রেকর্ড ৩০.০৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২.৫৭ বিলিয়ন ডলার, যা অর্থনীতির জন্য বড় ইতিবাচক ইঙ্গিত।
২০২৫ সাল ব্যাংকিং খাতের জন্য পুনরুদ্ধারের বছর নয়, বরং ভুলের হিসাব চুকানোর বছর হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিনের লুটপাট, রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও দুর্বল তদারকির ফল আজ নগ্নভাবে সামনে এসেছে। সংস্কারের উদ্যোগ শুরু হলেও তা কতটা টেকসই হবে—তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের ওপর।
























