
মাত্র এক রান বাকি। লর্ডসের স্টেডিয়াম তখন নিঃশব্দ উত্তেজনায় কাঁপছে। সবার দৃষ্টি মাঠে, দক্ষিণ আফ্রিকার ডাগআউটে তখন কেবল একজন বসা—অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। মাঠের শেষ বল ব্যাটে লাগার পরই যেন বিস্ফোরণ ঘটে যায় গ্যালারিতে। উল্লাসে ফেটে পড়া সেই মুহূর্তে বাভুমা নত হয়ে থাকেন—নিজের ভেতরে যেন চেপে ধরছিলেন এক দীর্ঘ ইতিহাস, শত বাধা আর অপমানের বেদনাকে।
লর্ডসে ৫ উইকেটে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। আইসিসির আসরে এটি তাদের প্রথম শিরোপা। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য এ জয় যতটা গৌরবের, বাভুমার জন্য এর চেয়েও বেশি কিছু—এ যেন আত্মপ্রমাণের পূর্ণতা।
এক সময়ের বর্ণবাদ-আক্রান্ত সমাজে জন্ম নেওয়া একজন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান হয়ে দেশের জাতীয় ক্রিকেটে জায়গা করে নেওয়া, তারপর কোটার অভিযোগ বয়ে বেড়ানো, মিমের চরিত্রে পরিণত হওয়া, সেসব পেরিয়ে নেতৃত্বে ওঠা এবং অবশেষে ইতিহাস গড়া—বাভুমার কাহিনি যেন দক্ষিণ আফ্রিকার আত্মসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।
২০১৪ সালে যখন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যাটার হিসেবে টেস্ট অভিষেক হয় তাঁর, তখন থেকেই শুরু হয় তাঁর লড়াই—শুধু নিজের নয়, কৃষ্ণাঙ্গদের সামর্থ্য প্রমাণের যুদ্ধ। অথচ ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে একাধিক ব্যর্থতায় ‘কোটা কাণ্ড’ ঘিরে বারবার আঙুল উঠেছে তাঁর দিকে। বিশেষত, অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর সে আলোচনা আরও তীব্র হয়। দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলের ব্যর্থতা, মাঠের পারফরম্যান্সে ওঠানামা, এমনকি ঘুমিয়ে পড়া ছবি—সবই যেন একত্রে চেপে বসেছিল তাঁর ওপর।
তবু দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ড বিশ্বাস রেখেছে তাঁর ওপর। 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আন্দোলনের সময় নেতৃত্বের মতো পরিস্থিতি সামলে দলে ঐক্য ধরে রাখার জন্য প্রশংসিত হয়েছেন নেতা হিসেবে। এবং এবার, সব প্রতিকূলতা পেছনে ফেলে, মাঠে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দেশের গর্বের মুহূর্ত এনে দিয়েছেন এই ‘কোটার অধিনায়ক’ বলে কটাক্ষ শোনা সেই বাভুমা।
এ জয়ের তাৎপর্য জাতীয় সীমানার বাইরেও বিস্তৃত। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা তাই বিশেষ করে বাভুমার নাম উল্লেখ করে বলেছেন, “এই জয় তোমার, এই জয় গোটা জাতির।” শৈশবে মিস্টার এমবেকির সঙ্গে করমর্দনের স্বপ্ন দেখে যে স্কুলপড়ুয়া বাভুমা, সেই বাভুমাই আজ প্রেসিডেন্টের অভিনন্দনের কেন্দ্রে।
শেষমেশ ইতিহাসটা তাই শুধু একটি ট্রফি জয়ের নয়, এটি বিশ্বাস, সংগ্রাম আর নীরব উত্তর দেওয়ার গল্প—যেখানে ‘কোটার খেলোয়াড়’ বলে খাটো করা একজন ব্যক্তি লর্ডসের মঞ্চে পরিণত হয়েছেন এক জাতির আশা ও আত্মমর্যাদার প্রতীক।