ঢাকা   শনিবার ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ৩ কার্তিক ১৪৩২

সাঙ্গু-মাতামুহুরী বনে হাতির শিকার চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে

অফবিট

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৫:২২, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

সাঙ্গু-মাতামুহুরী বনে হাতির শিকার চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে

দাঁতের জন্য হাতি শিকারের পাশাপাশি দেশে মাংসের জন্যও যে প্রাণীটি শিকার করা হচ্ছে, এই প্রথম তার প্রমাণ পেয়েছেন একদল গবেষক।

মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন পার্বত্য অঞ্চলের সাঙ্গু-মাতামুহুরী সংরক্ষিত বনে মাংসের জন্য হাতি শিকার করার একটি স্থানের সন্ধান পেয়েছেন তাঁরা। এই বনেই রয়েছে ‘সাঙ্গু বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য’।

এ বছরের এপ্রিলে এই বনে গবেষণা পরিচালনা করে চার সদস্যের দলটি। তাদের প্রতিবেদন ১৬ অক্টোবর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

নতুন এই তথ্য নিয়ে হাতিবিশেষজ্ঞ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ বললেন, এটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। মাংসের জন্য হাতি শিকারের কথা তিনি আগেও শুনেছিলেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাংসের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে হাতি শিকার করা হয়, বহুদিন ধরে এমনটা শোনা গেলেও কোনো প্রমাণ ছিল না। এই প্রথম তার সত্যতা পাওয়া গেল।

এপ্রিলের ২৫ তারিখ সাঙ্গু-মাতামুহুরীর গহিন বনে একটি মাচার ওপর হাতির মাংস শুকানোর প্রমাণ পায় গবেষক দল। স্থানটি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সীমান্তসংলগ্ন এলাকা।

৩৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও তিন ফুট উচ্চতার মাচার ওপর হাতির মাংসের শুকনা টুকরা পাওয়া গেছে। গবেষক দলের ধারণা, এ জন্য একটি পূর্ণ বয়স্ক হাতি হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। হাতির মাংসের পাশাপাশি হাতির হাড় ও চামড়া আগুন দিয়ে শুকানো হচ্ছিল।

স্থানীয় লোকজন সম্প্রতি হাতি নিধনের এ রকম কয়েকটি ঘটনা নিশ্চিত করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।


চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও শেরপুর এলাকায় হাতির জন্য যে হুমকি রয়েছে, তা সাঙ্গু অভয়াশ্রমে না থাকলেও এই ঘটনা নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে বলে গবেষকদের মন্তব্য।

গবেষক দলের একজন সদস্য নাম প্রকাশ করার শর্তে গণমাধ্যম কে  বলেন, ‘সাঙ্গু-মাতামুহুরীর সংরক্ষিত বন এখনো তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রাকৃতিক বনের সব বৈশিষ্ট্য এখানে অক্ষত রয়েছে। এ বন হাতির আবাসস্থল হিসেবে বেশ সমৃদ্ধ এখনো। মাংসের জন্য হাতি হত্যা এখানে একটি বড় উদ্বেগ।’

মাংসের জন্য মারা হাতির শুকনা হাড় ও দাঁত মিয়ানমারে পাচার করা হতে পারে বলে তার ধারণা।

বনের মধ্যে বসবাস, এমন একটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের বক্তব্য নিয়েছে কেমব্রিজের গবেষক দলটি। স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের কয়েকটি চক্র হাতি শিকারে জড়িত।

গবেষক দলটি যে পথ দিয়ে গেছে, তার পুরোটাই হাতির মল ও পায়ের ছাপ পেয়েছেন। নভেম্বর থেকে মার্চ— এই সময়টাতে মিয়ানমার থেকে নিয়মিত হাতির আসা-যাওয়া থাকে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানতে পেরেছে দলটি।

এশিয়ান এলিফ্যান্ট স্পেশালিস্ট গ্রুপের সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ গণমাধ্যম কে  বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়, ২৫ বছর আগে যখন হাতি নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে কাজ করতে গেলাম, তখন প্রথম শুনি যে হাতির মাংস খাওয়ার চল আছে পার্বত্য অঞ্চলে। রাঙামাটির বরকল, পাবলাখালী, খাগড়াছড়ির রাঙ্গিপাড়া—এসব এলাকায় হাতির মাংস খাওয়া হতো, সেটি শুনেছি। এমনও শুনেছি যে পূর্ণ বয়স্ক হাতি হত্যা অনেক সময় কঠিন হওয়ায় ওরা আগুন দিয়ে তাড়ানোর সময় বাচ্চা হাতি ধরে সেগুলোর মাংস খেত। তবে কখনো দেখিনি।’

২০১৯ সালে মালয়েশিয়ার সাবাহ শহরে এশিয়ান এলিফ্যান্ট স্পেশালিস্ট গ্রুপের এক সেমিনারের তথ্য তুলে ধরে এ হাতিবিশেষজ্ঞ বলেন, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড নামে একটি সংগঠন মিয়ানমারে হাতি হত্যার ওপর দেওয়া এক প্রেজেন্টেশন দেয়। সেখানে উল্লেখ ছিল, ২০১৯ সালে ৬৭টি হাতি হত্যা করা হয় মাংস খাওয়ার জন্য। এ ছাড়া হাতির চামড়া বর্গাকারে শুকিয়ে সেগুলো চীনে পাচার করা হতো, ওই প্রেজেন্টেশনে উল্লেখ করা হয়।

নতুন গবেষণা নিয়ে অধ্যাপক আজিজ বলেন, ‘এটা অস্বাভাবিক কিছু না। মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে এটা হয়। কারণ দুই পাড়ে যাতায়াত আছে। আমরা যেটা এত দিন শুনে আসছি, তারা সেটির হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছে।’

বন বিভাগের তথ্য বলছে, গত ৯ বছরে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ১১৪টি হাতি মারা গেছে; কিন্তু বন আদালতে মামলা হয়েছে মাত্র ১৯টি। আর থানায় সাধারণ ডায়েরি হয়েছে ৭৫টি। একই সময়ে নেত্রকোনা, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও জামালপুরে ৩২টি হাতি হত্যার শিকার হয়।

চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে মারা যাওয়া ১১৪টি হাতির মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় ৭টিকে; বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয় ২৬টি। দুর্ঘটনার কারণে ১৮টি, অসুস্থ হয়ে ৪০টি, বয়সের কারণে ১৫টি ও অজ্ঞাত কারণে ১০টি হাতি মারা পড়ে।

হাতি সংরক্ষণের জন্য বন বিভাগের করা ‘হাতি সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২৭’ এ হাতির দাঁত ও দেহাংশের পাচার নিয়ে খুব কম তথ্য পাওয়া যায়; কিন্তু ওই কর্মপরিকল্পনায় ভারত ও মিয়ানমারে হাতি পাচারের ঘটনা বৃদ্ধি বাংলাদেশের হাতিকেও ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কার কথা আছে।

প্রকৃতি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএনের ২০০৪ সালের এক গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে ওই কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়, একটি পাহাড়ি সম্প্রদায় মাংস খাওয়ার জন্য হাতি হত্যা করে থাকে।

ওই কর্মপরিকল্পনায় ১৯৯২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ৭টি হাতির দেহাংশ চুরির তথ্য দেওয়া আছে।

২০১৬ সালে হাতি নিয়ে করা সর্বশেষ জরিপে বাংলাদেশে ২৬৮টি হাতির সন্ধান পেয়েছিল আইইউসিএন। এর পরই হাতিকে মহাবিপদাপন্ন হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করে প্রকৃতি সংরক্ষণে কাজ করা সংস্থাটি।

দেশের বন্য প্রাণী আইনে হাতি হত্যা নিষিদ্ধ। কেউ এই অপরাধ করলে তার সর্বনিম্ন দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড হবে। সেই সঙ্গে ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধানও রয়েছে।