
সোনার দামে আগুন লেগেই আছে। বৈশ্বিক অস্থিরতা, ডলারের দামের চাপ ও আমদানিতে বিধিনিষেধের কারণে বাংলাদেশের বাজারে সোনার দাম পৌঁছেছে রেকর্ড উচ্চতায়। ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম বর্তমানে ১ লাখ ৭২ হাজার ৩৩৬ টাকা, যেখানে ২০২৪ সালের শেষদিকে এই দাম ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার ৫৮৬ টাকা। মাত্র ছয় মাসে দাম বেড়েছে ৩১ হাজার ৭৫০ টাকা, যা ভোক্তাদের জন্য মারাত্মক চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে বিয়েশাদির মতো পারিবারিক আয়োজনের সময়।
এই সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে সাম্প্রতিক আমদানি বিধিনিষেধের কারণে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাগেজ বিধিমালায় সোনা আনায় বড় ধরনের কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। আগে বছরে যতবার খুশি একজন যাত্রী বিদেশ থেকে ফিরলে ১০০ গ্রাম সোনার গয়না বিনা শুল্কে আনতে পারতেন, এবার সেই সুবিধা সীমাবদ্ধ করা হয়েছে বছরে একবার ১০০ গ্রামে। একইভাবে, আগে বছরে প্রতিবার ১১৭ গ্রাম ওজনের একটি সোনার বার আনতে পারলেও এবার তা কমিয়ে বছরে একবার একটি বার নির্ধারণ করা হয়েছে। তারও ওপর ভরিপ্রতি শুল্ক ৪ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫ হাজার টাকা, ফলে একটি সোনার বারের জন্য শুল্ক দিতে হবে ৫০ হাজার টাকা।
বাংলাদেশের সোনার দামের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনা করলেও দেখা যাচ্ছে, ব্যবধান বিশাল। দুবাইয়ে ২২ ক্যারেটের এক ভরি সোনার দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ৬৭৭ টাকা, আর ভারতে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৩২ টাকা। অর্থাৎ, বাংলাদেশের তুলনায় দুবাইয়ে সোনা ২৮ হাজার ৬৫৯ টাকা এবং ভারতে ১৬ হাজার ৯০৪ টাকা সস্তা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোনার দামে এ ধরনের ব্যবধানের মূল কারণ হলো, বাংলাদেশে কমোডিটি এক্সচেঞ্জ নেই, বাণিজ্যিকভাবে আমদানি হয় না, পরিশোধনের কোনো কারখানা নেই, এবং বাজার চাহিদার বড় অংশই এখনো নির্ভর করে ব্যাগেজ বিধিমালায় আনা সোনার ওপর। কিছু পুরোনো অলংকার রিসাইক্লিং করা হলেও তা চাহিদার সামান্য অংশ পূরণ করে। তদুপরি, অবৈধ পথে সোনা আসার অভিযোগ রয়েছে বহুদিন ধরে।
সোনার বাজারে স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতা আনতে ২০১৮ সালে স্বর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার। এরপর ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক আমদানির লাইসেন্স দিলেও, ডলার সংকট, অনুমতির জটিলতা ও ভ্যাট সমস্যার কারণে সেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দেশে বৈধ পথে সোনার আমদানি কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ে।
এমন পরিস্থিতিতে অলংকার আনায় কড়াকড়ি আরোপ করাকে যুক্তিযুক্ত মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জুয়েলার্স সমিতির এক নেতা বলেন, “যেহেতু বৈধভাবে আমদানি হয় না, পরিশোধনের কারখানাও নেই, কড়াকড়ি আরোপে অবৈধ পথে সোনা আসা বাড়বে, বাজার আরও অস্থির হবে।”
জুয়েলার্স সমিতি বাজেটের আগে এনবিআর’র সঙ্গে আলোচনায় বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছিল, যেমন: অলংকার বিক্রিতে ভ্যাট ৫% থেকে কমিয়ে ২%, সোনা কেনায় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি, ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু এবং পরিশোধন কারখানার জন্য ১০ বছরের কর অব্যাহতি। তবে এসব প্রস্তাবের মধ্যে কেবল ব্যাগেজ বিধিমালায় কড়াকড়ির প্রস্তাবটিই বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
এই বিষয়ে জুয়েলার্স সমিতির নির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, “সোনা আমদানি সহজ না করে শুধু ব্যাগেজ বিধিমালায় কড়াকড়ি করলে সংকট বাড়বে। বাজারে সরবরাহ না থাকলে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। ফলে চোরাচালান বাড়বে, যা বাজারকে আরও অনিয়ন্ত্রিত করে তুলবে।”