
বিদেশে শাখা বা প্রতিনিধি অফিস খুলতে এবার কঠোর শর্ত আরোপ করলো বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নীতিমালায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, শুধুমাত্র আর্থিকভাবে মজবুত, অভিজ্ঞ ও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ‘এ’ ক্যাটাগরির ব্যাংকগুলোই দেশের বাইরে ব্যবসা পরিচালনার অনুমতি পাবে। ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বিদেশে শাখা খুলতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কমপক্ষে সাত বছরের কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পাশাপাশি, ব্যাংকটির আর্থিক রেটিং ‘শক্তিশালী’ বা ‘সন্তোষজনক’ হতে হবে এবং অবশ্যই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও ‘এ’ ক্যাটাগরিভুক্ত হতে হবে। ফলে দুর্বল এবং স্বল্প অভিজ্ঞ ব্যাংকগুলোর জন্য বিদেশে কার্যক্রম বিস্তারের পথ অনেকটা বন্ধ হয়ে গেল।
বর্তমানে বেশ কয়েকটি তুলনামূলক দুর্বল ব্যাংক বিদেশে কার্যক্রম চালালেও নতুন নীতিমালার ফলে তাদের ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের সম্ভাবনা কমে যাবে। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়োগে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং নিয়োগপ্রাপ্তদের আয়ের অংশ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
বিদেশি নিয়ন্ত্রক সংস্থার (যেমন—সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক) অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যাংক বিদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। একই সঙ্গে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে, প্রস্তাবিত দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকা বাধ্যতামূলক। এবং যদি ঐ দেশে ইতোমধ্যে কোনো বাংলাদেশি ব্যাংক সক্রিয় থাকে, তাহলে নতুন শাখা খোলার যৌক্তিকতা স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
এক্সচেঞ্জ হাউস খোলার ক্ষেত্রেও নির্ধারণ করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড। সংশ্লিষ্ট দেশে কতজন বাংলাদেশি প্রবাসী রয়েছে, তারা রেমিট্যান্স পাঠায় কী পরিমাণ, দ্বিপক্ষীয় আর্থিক লেনদেনের পরিসর কতটুকু—এসব তথ্যের ভিত্তিতে অনুমোদন দেওয়া হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো, বিদেশে পরিচালিত ব্যাংক শাখা বা সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর খরচ তাদের নিজেদের আয়ের মাধ্যমেই বহন করতে হবে। এবং প্রতি অর্থবছরের শেষে বিদেশে অর্জিত নিট মুনাফা দেশে ফেরত আনতে হবে—যা বাধ্যতামূলকভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০০১ সাল থেকে দেশের কিছু ব্যাংক বিদেশে শাখা, এক্সচেঞ্জ হাউস, ফাইন্যান্স কোম্পানি ও প্রতিনিধি অফিস খুলে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। কিন্তু এর পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আর্থিক স্বচ্ছতা এবং দক্ষতা নিশ্চিত করতে এই নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়েছে।
বিশ্লেষণ ও পরামর্শ:
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই পদক্ষেপ ব্যাংক খাতে গুণগত মান উন্নয়নের একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ। অতীতে কিছু দুর্বল ও অপর্যাপ্ত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যাংক বিদেশে শাখা খুলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিংবা কার্যকর সেবা দিতে পারেনি। এর ফলে দেশের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি বিনিয়োগের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ‘এ’ ক্যাটাগরি নির্ধারণের বিষয়টি আর্থিক স্বচ্ছতা, নিয়মিত অডিট, বিনিয়োগকারীদের আস্থা এবং ব্যাংকের পরিচালন দক্ষতার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই এই শর্ত বিদেশে ভালো মানের ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে একদিকে যেমন দেশের ব্যাংক খাত আরও সংগঠিত ও জবাবদিহিমূলক হবে, অন্যদিকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে সক্ষম হবে সেরা মানের ব্যাংকগুলো। তবে নীতিমালার প্রয়োগে যেন অপ্রয়োজনীয় প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি না হয় এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সেবায় যেন বিঘ্ন না ঘটে, সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
উপসংহার:
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নতুন নির্দেশনা দেশের ব্যাংক খাতকে গুণগত মান ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ‘এ’ ক্যাটাগরির ব্যাংকগুলোকেই বিদেশে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুস্পষ্টভাবে বার্তা দিচ্ছে—কেবল মজবুত আর্থিক কাঠামো ও স্বচ্ছ পরিচালনা থাকলেই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করা যাবে। এতে ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইতিবাচক প্রতিযোগিতা বাড়বে, প্রবাসী গ্রাহকেরা মানসম্পন্ন সেবা পাবেন এবং দেশের সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত হবে অধিকতর দায়িত্বশীল ও বিশ্বস্ত।