
ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় আজ আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলো। টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেন বিরাট কোহলি। সোমবার নিজের ইনস্টাগ্রাম পোস্টে এই সিদ্ধান্ত জানান দেন ভারতীয় ক্রিকেটের আধুনিক যুগের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান। ৩৬ বছর বয়সী কোহলি এর আগে ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিকে বিদায় জানিয়েছিলেন। এখন থেকে তিনি শুধুমাত্র ওয়ানডে ক্রিকেটে মনোযোগ দেবেন।
স্মৃতিময় সেই মুহূর্ত স্মরণ করে কোহলি লিখেছেন, “টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবার ব্যাগি নীল পরেছিলাম ১৪ বছর আগে। তখন কল্পনাও করিনি, এই ফরম্যাট আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে। এটি আমাকে অনেকবার পরীক্ষায় ফেলেছে, আবার গড়েও তুলেছে। এমন কিছু শিক্ষা দিয়েছে, যা সারাজীবন মনে রাখব।”
২০১১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয়েছিল কোহলির। এরপর ১২৩টি টেস্ট ম্যাচে ব্যাট হাতে করেছেন ৯,২৩০ রান, যার মধ্যে রয়েছে ৩০টি শতক। ব্যাটিং গড় ৫০-এর কাছাকাছি হওয়ায় তাঁকে বলা হতো টেস্টের ‘শৃঙ্খলার যোদ্ধা’। তাঁর ক্যারিয়ারে অনেক ম্যাচজয়ী ইনিংস, দুর্দান্ত নেতৃত্ব আর জেদি মানসিকতা তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
সাদা পোশাকের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে কোহলি বলেন, “সাদা পোশাকে খেলার মধ্যে একটা গভীর ব্যক্তিগত অনুভব থাকে। নিঃশব্দ পরিশ্রম, দীর্ঘদিনের সংগ্রাম, ছোট ছোট মুহূর্ত—যেগুলো কেউ দেখে না, কিন্তু সেগুলোই আজীবন মনে গেঁথে থাকে।”
তবে সাম্প্রতিক ফর্ম ছিল প্রশ্নের মুখে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে শেষ টেস্ট সিরিজে ৯ ইনিংসে করেন মাত্র ১৯০ রান, গড় ছিল ২৩.৭৫। ধারাবাহিকভাবে অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলতে গিয়ে স্টাম্পের পেছনে ক্যাচ দিয়ে আউট হওয়ায় ক্রিকেট বিশ্লেষকদের নজর পড়ে তাঁর টেকনিক ও মানসিক স্থিতির ওপর।
ভারতীয় বোর্ড বিসিসিআই তাঁকে অবসর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ করলেও কোহলি নিজের জায়গায় অনড় ছিলেন। নিজের পোস্টে লেখেন, “এটা সহজ সিদ্ধান্ত নয়, কিন্তু আমার কাছে এটাই সঠিক মনে হচ্ছে। আমি টেস্ট ক্রিকেটকে সবকিছু দিয়েছি, আর এটি আমাকে তার চেয়েও অনেক বেশি ফিরিয়ে দিয়েছে।”
ভক্ত, সতীর্থ ও দলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কোহলি লিখেছেন, “আমি কৃতজ্ঞতায় ভরা হৃদয় নিয়ে বিদায় নিচ্ছি—এই খেলাটার প্রতি, মাঠে আমার সঙ্গী হওয়া মানুষদের প্রতি; আর তাঁদের প্রতি, যাঁরা আমাকে এই পথচলায় সম্মান ও ভালোবাসা দিয়েছেন।”
ভারতের ২৬৯তম টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা কোহলি বিদায় জানালেন একটি গর্বিত হাসি নিয়ে। তাঁর ক্যারিয়ারের গল্প এখন ইতিহাসে ঠাঁই নেবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হয়ে থাকবে এক অনন্য অনুপ্রেরণা।
সাদা পোশাকে ব্যাটসম্যানের শাসন: টেস্টে বিরাট কোহলির সেরা ইনিংসগুলো
বিরাট কোহলির টেস্ট অবসর ঘোষণা যেমন আবেগঘন, তেমনি একটি গৌরবময় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি। ১৪ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে ১২৩ ম্যাচে ৯২৩০ রান, ৩০টি সেঞ্চুরি এবং অসংখ্য স্মরণীয় ইনিংস উপহার দিয়েছেন তিনি। চলুন ফিরে দেখা যাক, সাদা পোশাকে ব্যাট হাতে কোহলির সবচেয়ে উজ্জ্বল কিছু মুহূর্ত—
১. ১৪১ রান বনাম অস্ট্রেলিয়া (অ্যাডিলেড, ২০১৪)
এই ইনিংসই কোহলিকে টেস্টের পরিণত ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ম্যাচে দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করলেও ৪র্থ ইনিংসে ১৪১ রানের ইনিংস ছিল অনবদ্য। জয় হাতছাড়া হলেও প্রতিপক্ষের মাটিতে সাহসী ব্যাটিং নেতৃত্বের নমুনা হিসেবে এটি ইতিহাসে ঠাঁই নিয়েছে।
২. ১৬৯ রান বনাম অস্ট্রেলিয়া (মেলবোর্ন, ২০১৪)
২০১৪ সালের সেই সিরিজে কোহলির ধারাবাহিকতা ছিল ঈর্ষণীয়। মেলবোর্নে খেলে যাওয়া ১৬৯ রানের ইনিংসে ছিল দৃঢ়তা ও শৈল্পিকতা। অফস্টাম্পের বাইরের বলগুলোর প্রতি তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল দেখার মতো।
৩. ২০০ রান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ (অ্যান্টিগা, ২০১৬)
এটাই ছিল কোহলির প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি, আর এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর ‘ডাবল সেঞ্চুরি রাজত্ব’। অধিনায়ক হিসেবে এটি ছিল এক আত্মবিশ্বাসী ইনিংস, যা ভারতকে বড় জয় এনে দেয়।
৪. ২৩৫ রান বনাম ইংল্যান্ড (মুম্বাই, ২০১৬)
একটি ইনিংসে একদিকে ব্যাটিং, অন্যদিকে নেতৃত্ব—এই ম্যাচে দুই ভূমিকাতেই অনবদ্য ছিলেন কোহলি। এটি তাঁর ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ স্কোর এবং চাপে পড়ে ব্যাটিং অর্ডারকে টেনে তোলার দৃষ্টান্ত।
৫. ১৫৩ রান বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা (সেঞ্চুরিয়ন, ২০১৮)
দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে এই ইনিংস ছিল একা যুদ্ধের প্রতিচ্ছবি। পুরো দল ব্যর্থ হলেও কোহলি একাই লড়েছিলেন, হাল ছাড়েননি, এবং এক অসাধারণ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
৬. ১২৩ রান বনাম অস্ট্রেলিয়া (পার্থ, ২০১৮)
এই ইনিংসটি ছিল অস্ট্রেলিয়ার বাউন্সি পিচে ক্রিকেটীয় সাহসের প্রতীক। শর্ট বল সামলে এবং নিখুঁত ড্রাইভে তিনি দেখিয়ে দেন, কেন তাঁকে আধুনিক টেস্ট ব্যাটিংয়ের আদর্শ বলা হয়।
৭. ১৪৯ রান বনাম ইংল্যান্ড (এজবাস্টন, ২০১৮)
সমালোচনার জবাব দিতে এই ইনিংস ছিল নিখুঁত অস্ত্র। ইংলিশ কন্ডিশনে জেমস অ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে এই ইনিংসে কোহলি প্রমাণ করেন, তিনিই 'কিং কোহলি'।
বিশ্লেষণ ও প্রভাব:
কোহলির টেস্ট ইনিংসগুলো শুধু রান দিয়ে নয়, পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার ধরন দিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে। যখন প্রয়োজন ছিল প্রতিরোধের, তখন তিনি ছিলেন ঢাল; আবার যখন প্রয়োজন ছিল আক্রমণের, তখন তিনি ছিলেন তলোয়ার। তিনি টেস্ট ক্রিকেটে ‘ফিটনেস–ড্রিভেন’ সংস্কৃতিরও পথিকৃৎ।
উপসংহার:
বিরাট কোহলির সেরা টেস্ট ইনিংসগুলো একেকটি যেন একেকটি ক্রিকেটীয় ক্লাসরুম। তাঁর প্রতিটি ইনিংসে ছিল ধৈর্য, কৌশল, এবং প্রতিজ্ঞার মিশ্রণ। ভবিষ্যতের ক্রিকেটারদের জন্য এগুলো হয়ে থাকবে অনুপ্রেরণার বাতিঘর।