
বাংলা চলচ্চিত্র ও নাটকের পরিচিত মুখ তানিন সুবহা আর নেই। ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পারিবারিক সংগ্রাম এবং জীবনের নানা উত্থান-পতনের গল্প রেখে তিনি গতকাল চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন আগে ফেসবুকে লেখেন, “চুপচাপ চলে আসাটাও একধরনের আত্মরক্ষা।” সেটিই যেন হয়ে দাঁড়াল তাঁর জীবনের শেষ অভিমানের প্রতিচ্ছবি।
তানিনের জন্ম সৌদি আরবে, শৈশব কেটেছে পরিবারের সঙ্গে সেখানেই। ২০০৮ সালে দেশে ফিরে বরিশালের গৌরনদীতে নানা বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। দেখতে সুন্দরী, গানে পারদর্শী তানিন তখন থেকেই পরিচিত হন ‘নায়িকা’ বা ‘গায়িকা’ নামে। মুনমুন নামে এক বান্ধবীর উৎসাহে অংশ নেন একটি গানের প্রতিযোগিতায়। যদিও পরিবার চেয়েছিল শুধু পড়াশোনা, তানিন চেয়েছিলেন গান–অভিনয় দুটোই।
২০১২ সালে মাত্র সাত মাসের মেয়েকে রেখে বাড়ি থেকে পালিয়ে অংশ নেন ক্লোজআপ প্রতিযোগিতায়। পরে এক নাট্যপরিচালকের পরামর্শে অভিনয়ের দিকে ঝোঁকেন। কিন্তু শুরুটা ছিল কষ্টের—সুযোগ মিলছিল না, পরিবার থেকেও সমর্থন ছিল সীমিত। ফেসবুক আইডি খুলে পরিচালকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। প্রথম সুযোগ মেলে ছোট একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে। এরপর দীর্ঘ পথচলায় অভিনয় করেন নাটকে, সিনেমায়, কখনো সামান্য পারিশ্রমিকে, কখনো বিনা পারিশ্রমিকে।
ঢাকায় এসে থিতু হয়ে তিনি কাজ বাড়ান নাটকে। এরপর সিনেমায় অভিনয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে যান। তাঁর অভিনীত সাতটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, সাতটি রয়েছে মুক্তির অপেক্ষায়। তানিনের অভিনয়ের আদর্শ ছিলেন শাবনূর। পাশাপাশি ব্যবসাও শুরু করেন, কারণ জানতেন—এই ক্যারিয়ার চিরস্থায়ী নয়।
তানিন প্রায়ই ফেসবুকে অভিমানী কথা লিখতেন—কখনো কাজ থেকে বাদ পড়া, কখনো ঠকে যাওয়া, আবার কখনো কেবলই আত্মদর্শনের কথা। গত মাসে লিখেছিলেন, “গুরুত্ব চাওয়ার মধ্যে কোনো ভুল নেই, ভুল হলো—নিজেকে এমন জায়গায় ধরে রাখা, যেখানে তোমাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।” জুনের শুরুতে হাসিমুখে ছবি পোস্ট করে বলেছিলেন, “উড়তে জানলেই হয় না! মর্যাদার জন্য পালক ও কথা জানতে হয়।”
এরপরই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তানিন। প্রাথমিক চিকিৎসার পরও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ভর্তি হন বনশ্রীর একটি হাসপাতালে, পরে ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। হঠাৎ শুরু হয় বুকে ব্যথা ও বমি। অবশেষে ৯ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর চিকিৎসকেরা জানান, তানিন আর নেই।
শেষ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “বাবা থাকলে জীবনটা অন্য রকম হতো। এখনো স্বপ্ন দেখি, একসময় ভালো কিছু হবে। পরিবারের জন্যই আমি বাঁচতে চাই।” তানিন সুবহার এই কথাগুলো যেন তাঁর জীবনের সারাংশ। তরুণী এক অভিনেত্রীর স্বপ্ন, সংগ্রাম আর অব্যক্ত কষ্টের বিদায়ী অধ্যায়—বাংলা মিডিয়ার জন্য এক হৃদয়বিদারক ক্ষতি।