
স্কুলে যাওয়ার কথা বয়সী শিশু মো. ইয়াসিনের দিন শুরু হয় ভোরে, তবে পাঠশালায় নয়—ময়লা টানার কাজে। রাজধানীর কাফরুল এলাকায় অবস্থিত একটি বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রে (এসটিএস) প্রতিদিন সকালেই হাজির হয় ১৩ বছর বয়সী এই কিশোর। সামান্য চা-রুটি খেয়েই সে বেরিয়ে পড়ে ভ্যানচালকের সঙ্গে, বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করে ভারী ভ্যান ঠেলে নিয়ে যায় এসটিএসে।
এটি কেবল ইয়াসিনের গল্প নয়। রাজধানীর নানা প্রান্তে ঘুরে দেখা গেছে, এমন অসংখ্য শিশু প্রতিদিনই এই ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে যুক্ত হচ্ছে। নিজেদের কিংবা পরিবারের ভরণ-পোষণের দায় কাঁধে তুলে নিচ্ছে তারা—শৈশব হারিয়ে ফেলে ময়লার স্তূপে।
ভবনপ্রতি গড়ে ৩০টি ফ্ল্যাট থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি ইউনিট থেকে গড়ে ১৭০ টাকা করে সার্ভিস চার্জ আদায় করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ মাস শেষে একজন শিশুশ্রমিক পায় মাত্র ৬-৭ হাজার টাকা, যখন পুরো আয় মালিকের পকেটে জমা হয় ৬০ হাজার টাকার বেশি। শিশুদের ডাকে 'মহাজন' নামে যে ভ্যানচালক, তিনিও আসলে আরেকজন মালিকের অধীন। এই মালিকদের প্রত্যেকের অধীনে একাধিক ভ্যান থাকে, আর এসব চালাতে গিয়ে কাজে টানা হয় শিশুদের।
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২ অনুসারে, দেশে প্রায় ৩৫ লাখ শিশুশ্রমিক রয়েছে, যার মধ্যে ১০ লাখেরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত। অনেকেই কোনো পারিশ্রমিক পায় না। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়া এসব শিশুরা কখনো যায়নি স্কুলে, আবার কেউ কেউ গিয়েছে, কিন্তু ফিরতে পারেনি। আর যে কয়জন ফিরতে চায়, পরিবারিক বাস্তবতা ও শ্রেণিবৈষম্যের দেয়াল তাদের আটকে দেয়।
এসব কাজে ব্যবহৃত ময়লার মধ্যে থাকে ভাঙা কাঁচ, ধাতব টুকরা, সিরিঞ্জ, ব্লেডসহ নানাবিধ স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ জিনিস। কোনো সুরক্ষা ছাড়াই শিশুদের এসব বর্জ্যের সঙ্গে কাজ করতে হয়, ফলে হেপাটাইটিস বি, এইচআইভি কিংবা দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে তারা। শারীরিক অপুষ্টি, শ্বাসকষ্ট ও চর্মরোগ তো রয়েছেই।
শিশু অধিকারের কথা বারবার বলা হলেও, বাস্তবে এইসব শিশুদের নিয়ে নীতিনির্ধারকদের ভাবনার খুব একটা দেখা মেলে না। বরং এই শ্রম এখন একটি বাণিজ্যিক কাঠামোয় রূপ নিয়েছে। শিশুশ্রমের মাধ্যমে আয় করছে প্রতিষ্ঠান, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুদের ভবিষ্যৎ।
আশার কথা, সরকার এখন শিশুশ্রম চিহ্নিতকরণ ও নিবন্ধনের কাজ শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই শিশুদের বিকল্প উপার্জনের ব্যবস্থা ও শিক্ষা নিশ্চিত না করলে শুধু আইন দিয়ে তাদের রক্ষা করা যাবে না। দরকার বাস্তবভিত্তিক, আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বিত পরিকল্পনা।
২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের লক্ষ্য থাকলেও বাস্তবায়নের গতি নিয়ে রয়েছে সংশয়। তার আগেই যদি ব্যবস্থা না নেওয়া যায়, তবে আরও অনেক ইয়াসিন, জাহিদ, ইব্রাহীম হারাবে তাদের শৈশব—ময়লার স্তূপেই চাপা পড়বে তাদের স্বপ্ন।