
জান্নাতুল ফেরদৌস—ঢাকার হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী হলেও পরিচিতি পেয়েছেন এক নিবেদিত প্রাণ সমাজকর্মী ও বইপ্রেমী হিসেবে। নিজ অর্থায়নে দেশের ৭০টি পাঠাগারে বই পাঠানো, অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো কিংবা শিশুদের শিক্ষায় ভূমিকা রাখা—সবখানেই তার মমতার স্পর্শ। মানুষের দুঃখে তিনি যেমন কাঁদেন, তেমনি তাদের জন্য কিছু করাও যেন তার স্বভাব হয়ে উঠেছে।
পরিবার থেকেই তিনি পেয়েছেন মানবিকতার শিক্ষা। বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, মা গৃহিণী, ছোট ভাইসহ ছোট একটি পরিবার। বাবা-মা বইপড়ুয়া, তাই ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি একটানা ভালোবাসা জন্মায় জান্নাতুলের মনে। করোনাকালে তিনি যখন কোভিডে আক্রান্ত হন, তখন বই ছিল তার একমাত্র মানসিক আশ্রয়। সুস্থ হওয়ার পর মনে হয়েছিল, তার সংগ্রহে থাকা প্রায় পাঁচ হাজার বই পৌঁছে দিতে চান এমন পাঠকের হাতে, যাদের কাছে বই আছে, কিন্তু উপযুক্ত সংগ্রহ নেই।
এভাবেই শুরু হয় বই বিলির যাত্রা। ২০২১ সাল থেকে তিনি বিভিন্ন পাঠাগারে নিজের বই পৌঁছে দিতে থাকেন। এ পর্যন্ত দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ৭০টিরও বেশি পাঠাগারে বিনা মূল্যে বই পাঠিয়েছেন তিনি। তার এই উদ্যোগের অন্যতম অনুপ্রেরণা নিউইয়র্কপ্রবাসী সাংবাদিক ও পাঠাগার আন্দোলনের সমর্থক শেখ সিরাজুল ইসলাম।
তবে জান্নাতুল শুধু বই নিয়েই থেমে থাকেননি। ২০১৯ সালে সূর্যশিখা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার সমাজসেবামূলক কাজের আনুষ্ঠানিক শুরু হয়। পথশিশুদের পাঠদান, ব্লাড ক্যাম্পেইন, রক্তদাতা খোঁজা, ঈদ-রমজানে বাজার দেওয়া, শীতবস্ত্র বিতরণ, পিঠা উৎসব, হুইলচেয়ার বিতরণ—সব কিছুতেই ছিল তার সক্রিয় অংশগ্রহণ। ফুলের বিনিময়ে আহার প্রকল্পটি ছিল তাদের অন্যতম মানবিক প্রয়াস—যেখানে ফুল বিক্রি করা শিশুদের একবেলার খাবার দেওয়া হতো বিনিময়ে কোনো অর্থ নয়, শুধু একটি ফুলের।
২০২১ সালে সূর্যশিখা থেকে স্বেচ্ছায় সরে গিয়ে আরও বড় পরিসরে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন জান্নাতুল। ঢাকার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি কখনো খিলগাঁওয়ের রেললাইনে স্কুল চালিয়েছেন, কখনো পাহাড়ি অঞ্চলের শিশুদের হাতে তুলে দিয়েছেন শিক্ষা উপকরণ ও শীতবস্ত্র। পাশাপাশি নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য, শিশুদের সচেতনতা, হতদরিদ্রদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতেও কাজ করছেন নিরলসভাবে।
এই মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি ‘দুর্দিন ম্যাগাজিন বুকশপ’-এর যাত্রা শুরু করেন মাত্র ২ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে। এখন পর্যন্ত নিজেই তা পরিচালনা করে যাচ্ছেন।
চ্যালেঞ্জ, হয়রানি, নিরাপত্তাহীনতা—এসব অতিক্রম করেই আজকের জান্নাতুল। নিজের স্বপ্নের পথে তিনি অনড়। ভবিষ্যতে একজন গবেষক প্রাণীবিদ এবং সমাজসেবী হিসেবে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে চান আমৃত্যু।
জান্নাতুল ফেরদৌস প্রমাণ করেছেন, মানবিকতা আর বইয়ের আলো একসঙ্গে পথ দেখাতে পারে একটি জাতিকে।