ঢাকা   বুধবার ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২ পৌষ ১৪৩২

খেলাপি ঋণে টালমাটাল ব্যাংক খাত, উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ১৭ ব্যাংক

শেয়ারবাজার

শেয়ারবিজনেস ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৮:০৫, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫

সর্বশেষ

খেলাপি ঋণে টালমাটাল ব্যাংক খাত, উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ১৭ ব্যাংক

দেশের ব্যাংকিং খাত যখন খেলাপি ঋণের চাপে গভীর সংকটে, তখনই কিছুটা স্বস্তির খবর দিচ্ছে ১৭টি বেসরকারি ব্যাংক। সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের গড় হার যেখানে উদ্বেগজনকভাবে ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে, সেখানে এই ১৭ ব্যাংক তাদের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমান বাস্তবতায় এটি নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী ও আশাব্যঞ্জক অর্জন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৫২টি স্থানীয় ব্যাংক। এর মধ্যে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকা ব্যাংকগুলোর তালিকায় রয়েছে— সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক ও সিটিজেনস ব্যাংক।

ব্যাংকিং খাতের বিশ্লেষকদের মতে, এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে ঋণ বিতরণে সতর্কতা, গ্রাহক যাচাইয়ে কঠোরতা, সময়মতো ঋণ আদায় এবং শক্তিশালী নজরদারি ব্যবস্থা। পাশাপাশি সুশাসন, স্বচ্ছতা ও ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বজায় রাখাও বড় ভূমিকা রেখেছে। অনেক ব্যাংক যেখানে দ্রুত প্রবৃদ্ধির তাগিদে ঝুঁকিপূর্ণ বড় ঋণে জড়িয়ে পড়েছে, সেখানে এসব ব্যাংক ধীরগতিতে হলেও টেকসই ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিয়েছে।

১৭টি ব্যাংকের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে কম সিটিজেনস ব্যাংকে—মাত্র ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর তালিকার শীর্ষে রয়েছে যমুনা ব্যাংক, যেখানে খেলাপি ঋণের হার ৯ দশমিক ৬ শতাংশ (চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত)। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে আরও দেখা যায়, সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশেরও নিচে।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে সিটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন জানান, ২০২৪ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৩ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০২৫ সালের শেষে তা ৩ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে। তার ভাষায়, শক্তিশালী সুশাসন কাঠামো ও বোর্ডের হস্তক্ষেপমুক্ত পেশাদার সিদ্ধান্তই এই অগ্রগতির মূল ভিত্তি।

ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলি রেজা ইফতেখার জানান, গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তাদের খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৩ শতাংশের কাছাকাছি। ঋণ অনুমোদনের আগে গ্রাহকের আর্থিক সক্ষমতা যাচাই এবং ঋণ বিতরণের পর নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমেই এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি।

প্রাইম ব্যাংকের ক্ষেত্রে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে খেলাপি ঋণের হার ৪ দশমিক ১ শতাংশ। ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান ও. রশিদ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ খাত এড়িয়ে চলা, কঠোর যাচাই ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণই তাদের নীতির মূল স্তম্ভ।

অন্যদিকে, ব্র্যাক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ব্যাংকটির বোর্ডে স্বাধীন পরিচালকদের আধিপত্য এবং মালিকপক্ষের হস্তক্ষেপহীন ব্যবস্থাপনা সুশাসনের শক্ত ভিত গড়ে তুলেছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রেফাত উল্লাহ খান জানান, দক্ষ রিকভারি টিম ও সমস্যাগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাদের ব্যবসা সচল রাখার কৌশল আদায় প্রক্রিয়াকে সহজ করেছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কোনো ধরনের সুপারিশ বা চাপের মুখে ঋণ অনুমোদন না দেওয়ার নীতিই ব্যাংকটিকে তুলনামূলক নিরাপদ অবস্থানে রেখেছে।

সব মিলিয়ে, খেলাপি ঋণে নাজুক হয়ে পড়া ব্যাংক খাতের মধ্যেও এই ১৭ ব্যাংক দেখাচ্ছে—সুশাসন, স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা থাকলে সংকটের মাঝেও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। চাইলে এটিই হতে পারে পুরো খাতের জন্য অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত।

সর্বশেষ