ঢাকা   মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২

কারসাজির ফাঁদে আবারও ’হিরু গং’, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স কেলেঙ্কারিতে ২.৫ কোটি টাকা জরিমানা

শেয়ারবাজার

শেয়ারবিজনেস ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ১৭ জুন ২০২৫

সর্বশেষ

কারসাজির ফাঁদে আবারও ’হিরু গং’, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স কেলেঙ্কারিতে ২.৫ কোটি টাকা জরিমানা

শেয়ারবাজারের পরিচিত নাম আবুল খায়ের হিরু এবং তার ঘনিষ্ঠ নেটওয়ার্ক আবারও আলোচনার কেন্দ্রে। সম্প্রতি তালিকাভুক্ত বীমা কোম্পানি ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স–এর শেয়ারদামে কারসাজির অভিযোগে হিরু ও তার পরিবারসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানকে মোট ২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

এই কারসাজি মূলত সংঘটিত হয়েছে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃক গৃহীত তদন্তে উঠে আসে, মাত্র দুই মাসে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারের দাম ১০৭ শতাংশ বেড়ে ৪৪ টাকা ২০ পয়সা থেকে ৮৫ টাকা ৪০ পয়সায় উঠে যায়। এর পেছনে ছিল ধারাবাহিক সিরিয়াল ট্রেডিং, কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি, এবং মন্দা বাজারেও শেয়ার নিয়ে গুজব ছড়ানোর কৌশল।

বিএসইসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগ জানায়, এই কারসাজির মাধ্যমে হিরু ও তার ঘনিষ্ঠরা ২ কোটি ৩৬ লাখ টাকার রিয়ালাইজড গেইন অর্জন করেছেন এবং এখনো তাদের হাতে থাকা শেয়ারের আনুমানিক মূল্যবৃদ্ধি, অর্থাৎ আনরিয়ালাইজড গেইন, দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭ কোটি ৫ লাখ টাকা

রিয়ালাইজড গেইন বলতে বোঝায়—বাজারে শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সরাসরি যে লাভ উঠে আসে। আর আনরিয়ালাইজড গেইন হচ্ছে—যে শেয়ারগুলো এখনো বিক্রি হয়নি, কিন্তু বাজারদর বাড়ায় বিক্রি করলে যে মুনাফা পাওয়া যাবে তার সম্ভাব্য পরিমাণ।

আবুল খায়ের হিরু শুধু একজন ব্যক্তি নন, বরং দীর্ঘদিন ধরেই একটি প্রভাবশালী কারসাজি চক্রের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তিনি সমবায় অধিদপ্তরের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত থাকলেও, তার প্রভাব ছড়িয়েছে দেশের শেয়ারবাজারে। অতীতেও তার নামে এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামে কারসাজির দায়ে একাধিকবার জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সেই জরিমানা ছিল কম, যা অবৈধ লাভের তুলনায় নগণ্য। ফলে এসব শাস্তি কার্যত নিরুৎসাহিত করতে পারেনি বরং তাকে আরও বেপরোয়া করেছে।

এবারের অভিযানে আবুল খায়ের হিরু ছাড়াও তার স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বাবা আবুল কালাম মাতবর, ব্যবসায়ী অংশীদার ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, এবং পরিবার পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ইশাল কমিউনিকেশন, মোনার্ক মার্ট, মোনার্ক এক্সপ্রেস ও লাভা ইলেক্ট্রোডস ইন্ডাস্ট্রিজ–কে জড়িত পাওয়া গেছে। এদের প্রত্যেককেই শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, হিরু এবং তার নেটওয়ার্ক একাধিক ব্রোকারেজ হাউস ও বিভিন্ন বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যেই লেনদেন চালিয়ে শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়িয়েছেন। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে যে শেয়ারের প্রতি চাহিদা বেড়েছে। এই মিথ্যা সংকেত ব্যবহার করে তারা চুপিচুপি নিজেদের লাভের ব্যবস্থা করেছেন।

এই ঘটনায় বিএসইসি সরাসরি ডিএসই'র তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী শুনানি সম্পন্ন করে জরিমানার সিদ্ধান্ত নেয়। কমিশনের ওয়েবসাইটে চলতি মাসের শুরুতে এই জরিমানা সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।

এটি প্রথম নয়। গত বছর ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে, হিরু ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে চারটি কোম্পানির শেয়ারে কৃত্রিম দাম বাড়ানোর অভিযোগে ১৩৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। একই বছর সেপ্টেম্বরে, আরও ১১টি কোম্পানির স্টকে অবৈধ লেনদেনের জন্য ১৪ কোটি টাকা জরিমানা করে কমিশন। এছাড়া, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সে শেয়ার কারসাজির ঘটনায় সাকিব আল হাসানকেও ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় এবং তাকে বিএসইসি'র শুভেচ্ছাদূতের পদ থেকে অপসারণ করা হয়।

আবুল খায়ের হিরু ও তার চক্র বছরের পর বছর ধরে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে অবৈধভাবে লাভ করেছে। বারবার জরিমানা সত্ত্বেও অপরাধের পুনরাবৃত্তি ইঙ্গিত দেয় যে বর্তমান আর্থিক জরিমানা তাদের জন্য বাধা নয়। এবার কমিশনের জরিমানা কার্যকর এবং আদায় কতটা দৃঢ় হয়, সেই দিকেই তাকিয়ে রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। অনেকেই মনে করছেন, কেবল অর্থদণ্ড নয়, প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক আইনানুগ ব্যবস্থা—যা ভবিষ্যতে অন্যদের জন্যও সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে।

 

সর্বশেষ