
মহানবী (সা.)-এর যে বক্তব্য বিশুদ্ধ সনদে আমাদের কাছে পৌঁছেছে—হোক সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘ, তা সুন্দরতম অভিব্যক্তি, শব্দ ও মর্মে অলংকারপূর্ণ, চিন্তার সৌন্দর্যসহ ভাষা-সাহিত্যের সব বিচারে মানবজাতির জন্য দৃষ্টান্ত ছিল। তাঁর ভাষা ছিল জাওয়ামিউল কালিম (সংক্ষিপ্ত বাক্যে বিস্তৃত মর্ম ব্যক্ত করা), প্রজ্ঞার রত্ন, অন্তরদৃষ্টি, শরিয়তের সুষমা, বিরল দৃষ্টান্ত, অতুলনীয় উপমা, ঐশী জ্ঞানের ধারক। তাঁর পবিত্র মুখনিসৃত শব্দ-বাক্যগুলো ছিল গভীরতাসম্পন্ন অথচ সহজবোধ্য, খুবই হৃদয়গ্রাহী এবং প্রাণবন্ত।
এই কথাগুলোর ভেতর প্রাণের সঞ্চারণ ছিল জীবন্ত ডালে রসের মতো।
তাঁর ভাষা প্রকৃত পক্ষে ছিল আল্লাহর নাজিলকৃত বাণীরই এক ছায়া; পবিত্র কোরআনের আলো থেকে উৎসারিত এক জ্যোতি। আর এ মূল্যায়নই যুগে যুগে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও বাগ্মীরা করেছেন।
বিখ্যাত আরব সাহিত্যিক আল-জাহিজ তাঁর ‘আল-বায়ান ওয়াত তাবিয়িন’ বইয়ে রাসুল (সা.)-এর ভাষা সম্পর্কে বলেন, তাঁর কথা ছিল অল্প শব্দে গভীর অর্থপূর্ণ, কৃত্রিমতামুক্ত, অহেতুক জটিলতা বর্জিত। যেখানে বিস্তার প্রয়োজন সেখানে বিস্তৃত আর সংক্ষিপ্ততার জায়গায় সংক্ষিপ্ত।
তিনি জটিল ও বিরল শব্দ পরিহার করেছেন, বাজারি কথা পরিহার করেছেন। তিনি যা বলতেন সবই প্রজ্ঞার উত্তরাধিকার। তিনি এমন শব্দও উচ্চারণ করেননি, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে সমর্থন ও সঠিক দিকনির্দেশনার বাইরে। তাঁর কথাগুলোর মধ্যে আল্লাহ এমন আকর্ষণ দান করেছেন যে তা সাধারণ গ্রহণ যোগ্যতা, মহিমা ও মাধুর্যের গুণে গুণান্বিত হয়েছে।
স্পষ্টতার সঙ্গে শব্দের স্বল্পতা, সহজবোধ্য অথচ গভীর। এমন এক ভাষা, যা পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন হয় না, প্রতিপক্ষের সামনে কখনো হারে না এবং মিথ্যার আশ্রয় নেয় না; বরং ছোট ছোট বাক্যে দীর্ঘ বক্তৃতাকেও ছাড়িয়ে যায়। তিনি কখনো প্রতিপক্ষকে এমন যুক্তি দিয়ে চুপ করান, যা তাঁর প্রতিপক্ষের জ্ঞানের বাইরে। তিনি সব সময় সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে যুক্তি তুলে ধরেন। তাঁর ভাষায় নেই কোনো কৌশলী চাতুরী, নেই ঘোরপ্যাঁচ বা ঘৃণা, নেই ধীরতা বা তাড়াহুড়া, অতিরিক্ত কথাও না আবার অপর্যাপ্ত কথাও না।
মানুষ তাঁর মতো সর্বজনীন, সত্যবাদী, ভারসাম্যপূর্ণ, সুদর্শন, মহৎ, উপযুক্ত, সহজপ্রাপ্য, অর্থবোধক এবং দৃষ্টান্তমূলক কথা আর কখনো শোনেনি।
আধুনিক যুগের বিখ্যাত ইসলামী সাহিত্যিক মুস্তাফা সাদিক আল-রাফি তাঁর ‘ইজাজুল কোরআন’ বইয়ে বলেন, ‘নবী করিম (সা.)-এর সহিহ হাদিসগুলো ভাষা ও বাগ্মিতার দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শব্দ নির্বাচন অত্যন্ত নির্ভুল, বাক্য গঠন চমৎকার, শব্দগুলোর পারস্পরিক সংযোগ সুন্দরভাবে সজ্জিত, বাক্য ভারী ও শালীন। শব্দ ও অর্থের মধ্যে সুস্পষ্ট সম্পর্ক বিদ্যমান। হাদিসে এমন কোনো শব্দ নেই, যা দুর্বল বা জোর করে বসানো হয়েছে, বরং প্রতিটি শব্দই সঠিক জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে এবং অর্থ প্রকাশে নিখুঁত। তাঁর কথায় থাকে সুস্পষ্ট প্রারম্ভ, পরিষ্কার গঠন, সুন্দর ব্যাখ্যা, স্পষ্ট সীমা, চমৎকার চিত্রণ এবং গভীর ও শক্তিশালী অর্থ। তাঁর বক্তব্যে অদ্ভুত ইঙ্গিত, ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি ও ঝকঝকে ব্যাখ্যার উজ্জ্বলতা থাকে কোনো কৃত্রিমতা বা দুর্বলতা ছাড়াই।’
বিখ্যাত ভাষাবিদ ও সাহিত্যিক মাহমুদ মুহাম্মদ শাকির বলেন, ‘আল-মুকতাতাফ’ নামক প্রবন্ধে আজকের যুগে যে উচ্চ দার্শনিক ভাবনার গভীরতা ও সরলতা একত্রে পাওয়া যায়, তা আরবিতে খুবই কম দেখা গেছে। এই গভীর অন্তর্দৃষ্টি, সত্যের গভীর অনুধাবন এবং তা প্রকাশের দক্ষতা এমন এক মানের সাহিত্যিক প্রতিভার কাজ, যা আরবিতে কেবল দুটি ক্ষেত্রে পাওয়া যায়— একটি হলো আল-কোরআন এবং অন্যটি হলো রাসুল (সা.)-এর বিশুদ্ধ হাদিস। এই দুই উৎসই আপনি এমন বক্তব্য পাবেন, যা নিজেই চিন্তার উচ্চতায় পৌঁছায়, শব্দ ও প্রকাশে অনন্য, এমনকি তা বিশাল সত্যগুলোর প্রতি বিস্তৃত হয়।
এর শব্দে থাকে আত্মার সুবাস, যা কখনো জান্নাতের হাওয়ার মতো কোমল ও সুগন্ধি, আবার কখনো হৃদয় বিদীর্ণকারী তীব্রতা, কখনো আগুনের মতো প্রজ্বালিত, আবার কখনো তা মানুষের গঠনের গভীরে কাঁপন তোলে। এ কারণেই কোরআন অলৌকিক আর হাদিস মানব ভাষার সর্বোচ্চ পর্যায়, যেখানে মানব প্রতিভার সর্বোচ্চ সীমা এসে থেমে যায়।
মাদখালুন লিদিরাসাতিস সুন্নাহ গ্রন্থ থেকে আলেমা হাবিবা আক্তারের ভাষান্তর