ঢাকা   শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

হতাশা জয় করে নাবিলার ডিঅ্যান্ডএডি জয়ের গল্প

নারী ও নারী উদ্যোক্তা

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৯:১২, ৩ জুলাই ২০২৫

হতাশা জয় করে নাবিলার ডিঅ্যান্ডএডি জয়ের গল্প

আগে কেউ থিয়েটার করে শুনলে প্রশ্ন করা হতো, ‘আর কী করেন?’ অভিনয়শিল্পী দম্পতি মিলি বাশার ও ফখরুল বাশার মাসুমও এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন বহুবার। পেশাজীবন একপাশে রেখে তাঁরা থিয়েটার করতেন। ফখরুল বাশারদের ছিল পারিবারিক টেলিযোগাযোগ ব্যবসা। সেই সূত্রে স্ত্রী ও বড় মেয়ে নাবিলা বাশারকে নিয়ে উড়াল দেন সৌদি আরবের রিয়াদে।

ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে, ফখরুল বাশারও সেখানে গিয়ে খুলে ফেলেন নিজেদের থিয়েটার গ্রুপ। মিলি বাশার গানের স্কুল খুলে গান শেখাতে শুরু করেন শিশুদের। ফলে বিনা খরচেই নাবিলা গান আর অভিনয়ের তালিম পেয়েছিলেন শৈশবেই।

সৌদি আরবের রিয়াদে বেড়ে উঠেছেন নাবিলা। সেখানেই করেছেন ও লেভেল, এ লেভেল। সমস্যা দেখা দেয় এ লেভেলের পর। সৌদি আরবে ২০০৫ সালেও নারীরা উচ্চশিক্ষা নিতে পারতেন না। বাধ্য হয়ে সে বছরই দুই মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরে আসেন মিলি বাশার।

আগ্রহ যখন বিজ্ঞাপনে
কিন্তু দেশে এসে কোথায় কী পড়বেন, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না নাবিলা বাশার। ফলে ২০০৫ সালে চলে যান মালয়েশিয়ায়। কুয়ালালামপুরে মালয়েশিয়ান ইনস্টিটিউট অব আর্ট থেকে ডিপ্লোমা করেন ভিজ্যুয়াল কমিউনিকেশনে। ২০০৮ সালের শুরুতে দেশে ফিরে শুরু করেন পেশাজীবন।

ছোটবেলা থেকেই শৈল্পিক, সৃজনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চেয়েছেন নাবিলা। আরও স্পষ্ট করে বললে, বিজ্ঞাপনই ছিল তাঁর আগ্রহের মাধ্যম। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আগ্রহের বিষয়েই পেয়ে যান চাকরি। ভিজ্যুয়ালাইজার হিসেবে যোগ দেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘মাত্রা’য়। ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে চলে যান দেশের আরেক শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞাপনী সংস্থা গ্রে-তে। ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানে ছিলেন ভিজ্যুয়ালাইজার, আর্ট ডিরেক্টর ও ক্রিয়েটিভ সুপারভাইজার পদে। এরপর ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক্স, এফসিবি বিটপি ও ম্যাগনিটো ডিজিটালেও কাজ করেছেন সহযোগী সৃজনশীল পরিচালক হিসেবে।

হতাশা ও নতুন শুরু
প্রায় এক যুগ বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোয় চাকরি করে নাবিলার একসময় মনে হয়েছিল, এখানে আর বিশেষ কিছু দেওয়ার বা পাওয়ার নেই। জীবন অনেকটা সরলরৈখিক হয়ে গেছে। তাই জীবনের শুরুটা করলেন নতুন করে।

চার বছরের মেয়ে আনাইশাকে মা-বাবা ও ছোট বোন নাজিবা বাশারের (অভিনেত্রী ও ডেইলি স্টারের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক) কাছে রেখে উড়াল দিলেন কানাডায়। বছরখানেক পর দাম্পত্যজীবনে নেমে এল বিচ্ছেদ। পড়াশোনা শুরু করলেন অন্টারিও কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন (ওসিএডি) থেকে বিজ্ঞাপন ও শিল্পনির্দেশনা বিষয়ে।

জীবনের কঠিনতম দিনগুলোর কথা মনে করে নাবিলা বলেন, ‘প্রতিদিন কাঁদতাম। আমার মেয়ের জন্য কী যে কষ্ট হতো! মনে হতো, আমি বোধ হয় খুবই খারাপ মা। একসঙ্গে তিনটা কাজ করতাম—ফ্রিডম ফোনের সেলসম্যান, ফ্রিল্যান্সিং আর আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ইউনিয়নের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে। পড়াশোনার প্রচণ্ড চাপ তো ছিলই। সারা দিন কঠোর পরিশ্রমের পর রাতে যখন বেহুঁশের মতো ঘুমাতাম, তখন বাংলাদেশে আমার মেয়ে ঘুম থেকে উঠত। তাই ওর সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা বা ভিডিও কলে দেখারও তেমন সুযোগ হতো না। ওই চার বছর অবিশ্বাস্য পরিশ্রম করেছি। জানতাম, হেরে যাওয়া বা ফিরে যাওয়া আমার জন্য কোনো অপশনই নয়। আমাকে পারতেই হবে, জিততেই হবে। চার বছর পর ২০২৪ সালের মে মাসে যখন মেয়েকে কানাডায় নিয়ে এলাম, তত দিনে ও অনেকটাই বদলে গেছে। নতুন করে আমি আবার মা হওয়া শিখলাম।’

২০২৩ সালে ‘ডিজাইন অ্যান্ড আর্ট ডিরেকশন পেনসিল অ্যাওয়ার্ড’ জেতেন নাবিলা বাশার। ১৯৬২ সাল থেকে ব্রিটিশ ডিজাইন অ্যান্ড আর্ট ডিরেকশনের পক্ষ থেকে ডিজাইন ও বিজ্ঞাপন অঙ্গনের সেরাদের ৫টি বিভাগে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিভাগগুলো হলো বিজ্ঞাপন, ক্রাফট, কালচার, ডিজাইন ও ইমপ্যাক্ট। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুরস্কার বরাদ্দ থাকে বিজ্ঞাপন বিভাগে।

নাবিলা বাশার এই পুরস্কার পেয়েছেন ডিজাইন বিভাগে। ২০২৩ সালে সারা বিশ্ব থেকে মাত্র ১৮ জন এই বিভাগে পুরস্কার পেয়েছেন। বিভিন্ন বিভাগে ডিঅ্যান্ডএডি পেনসিল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন মোট ৬০ জন। কয়েক রকম পেনসিল অ্যাওয়ার্ড আছে—উড পেনসিল, গ্রাফাইট পেনসিল, ইয়েলো পেনসিল, হোয়াইট পেনসিল ও ব্ল্যাক পেনসিল। এর মধ্যে নাবিলা পেয়েছেন গ্রাফাইট পেনসিল অ্যাওয়ার্ড। সেটার আবার দুটি ভাগ—ডিঅ্যান্ডএডি অ্যাওয়ার্ড ও নিউ ব্লাড অ্যাওয়ার্ড। ডিঅ্যান্ডএডি অ্যাওয়ার্ডটি মূলত পেশাদারদের জন্য, অন্যদিকে নিউ ব্লাড অ্যাওয়ার্ডটি এসব বিভাগে যাঁরা সদ্য স্নাতক করে বের হয়েছেন, সেই তরুণ গ্র্যাজুয়েটদের জন্য।

২০২৩ সালে সদ্য স্নাতক শেষ করা নাবিলাও এই পুরস্কার হাতে তুলেছেন নিউ ব্লাড বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রজেক্টে নাবিলার সঙ্গে এই পুরস্কার পেয়েছেন অন্টারিও কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইনের (ওসিএডি) মার্কিন তরুণ এরিয়েল রো।

ওই একই বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুনে নাবিলা স্নাতকে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন ‘পল স্টিভেনস অ্যাওয়ার্ড অব এক্সিলেন্স ইন টাইপোগ্রাফি’।

বছরটা ভালোয় ভালোয় শেষ হলেও নতুন চাকরি পেতে গিয়ে নাবিলা পড়লেন বিপাকে। কেননা, যে সময় নাবিলা স্নাতক করে বের হলেন, সে সময় কানাডায় অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চাকরির বাজারে ভাটা পড়েছিল।

প্রায় সাত মাস প্রতিদিন সকালে উঠে চাকরির আবেদন করেছেন নাবিলা। আর আগের মতোই লেনোভো ও ডিজাইন টিওতে ফ্রিল্যান্সিং করেছেন। সে সময় ভীষণ হতাশায় ডুবে গিয়েছিলেন। শেষমেশ নিজের প্রত্যাশিত চাকরি পান বহুজাতিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডিইপিটির টরন্টো অফিসে শিল্পনির্দেশক হিসেবে।

কানস লায়ন্সের অভিজ্ঞতা
গত ১৬ থেকে ২০ জুন নাবিলা বাশার ঘুরে এলেন ফ্রান্সের ‘কানস লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল অব ক্রিয়েটিভিটি’, সংক্ষেপে ‘কানস লায়ন্স’ থেকে। ক্রিয়েটিভ কমিউনিকেশন ও বিজ্ঞাপন–জগতের গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন কানস লায়ন্স। ১৯৫৪ সাল থেকে প্রতিবছর কান চলচ্চিত্র উৎসবের মূল আয়োজন শেষ হওয়ার কিছুদিন পর অনুষ্ঠিত হয় বিজ্ঞাপন–জগতের সবচেয়ে বড় এই আয়োজন। এ উৎসবে বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় পুরস্কার। সঙ্গে চলে বিভিন্ন ধরনের সেমিনার ও কর্মশালা।সে রকমই এক কর্মশালায় নাবিলা পেয়েছেন তাঁর বিজ্ঞাপন–জগতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরার সুযোগ। বলেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনশিল্পের নারীদের কথা এবং এই অঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। নাবিলা বলেন, ‘কানস লায়ন্সে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা দারুণ। আমি চাই, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে একাধিক নারী এ উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে অংশ নিক।’

এ বছর কানস লায়ন্স থেকে নাবিলার বিশ্ববিদ্যালয় অন্টারিও কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইনে (ওসিএডি) সাতটি আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয়। স্নাতক শেষ করার দুই বছর পরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নাবিলাকে কানস লায়ন্সে যাওয়ার জন্য মনোনীত করেছে। আর এই কান–যাত্রার অর্থায়ন করেছে তাঁর বর্তমান কর্মস্থল।

স্বপ্ন আরও বড়

নাবিলা বলেন, ‘কানাডায় জীবন শুরু করার পর তিনজনের কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ। একজন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট প্রধান, অধ্যাপক অ্যাঞ্জেলা বেইন্স। তিনি এখনো আমার ‘গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল’। বাকি দুজন বিজ্ঞাপনী সংস্থা কসেট টরন্টোর নির্বাহী সৃজনশীল পরিচালক ট্রেন্ট থমসন ও দানি গেইডে। তাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয় গ্রাউন্ডফ্লোর প্ল্যাটফর্মে। তাঁরা ‘ফার্স্ট নেক্সট স্টেপ’ নামে একটা প্যানেলে আমাকে স্পিকার হিসেবে আমন্ত্রণ করেছিলেন। যখন মনমতো চাকরি পাচ্ছিলাম না, বারবার হাল ছেড়ে দিতে মন চাইছিল, তখন তাঁরা আমাকে প্রতিনিয়ত সাহস দিয়েছেন। অনুপ্রাণিত করেছেন।’

নাবিলা এখন আরও বড় স্বপ্ন দেখেন। আর স্বপ্নগুলো সত্যি করতে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়েন কাজে।