ঢাকা   শুক্রবার ০৪ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

দুই বছরে দ্বিগুণ শেয়ারদর! ’আমরা নেটওয়ার্কের’ ডেটা সেন্টার বিক্রির রহস্যে বিএসইসির তদন্ত

শেয়ারবাজার

শেয়ারবিজনেস ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:৫৩, ৪ জুলাই ২০২৫

দুই বছরে দ্বিগুণ শেয়ারদর! ’আমরা নেটওয়ার্কের’ ডেটা সেন্টার বিক্রির রহস্যে বিএসইসির তদন্ত

অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধি, লাভজনক সম্পদ বিক্রি এবং অভ্যন্তরীণ লেনদেনের গন্ধে নড়েচড়ে বসেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।


তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ‘আমরা নেটওয়ার্ক লিমিটেড’ ডেটা সেন্টার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক বছরের মধ্যেই কোম্পানির শেয়ারদর প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এই অস্বাভাবিক দাম বাড়া এবং সম্পদ বিক্রির পেছনের কারণ খুঁজে বের করতে অনুসন্ধানে নেমেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে কমিশন।

কী ঘটেছে আমরা নেটওয়ার্কে?

২০২২ সালের ডিসেম্বরে আমরা নেটওয়ার্ক তাদের নিজস্ব ডেটা সেন্টার বিক্রির ঘোষণা দেয়। ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকায় প্রতিষ্ঠানটি তাদের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আমরা হোল্ডিংস-এর কাছে এই সম্পদ বিক্রি করে দেয়। বুকভ্যালু ছিল ৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, ফলে কাগজে-কলমে লাভ দেখায় ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

কিন্তু এরপরই শুরু হয় অস্বাভাবিক দাম বাড়ার ধারা। ২০২২ সালের আগস্টে যেখানে কোম্পানির শেয়ারের দর ছিল ৩৬.১০ টাকা, সেটি ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে দাঁড়ায় ৭২.৫০ টাকা। এরপর আরও ঊর্ধ্বগতি পেয়ে জুনে তা পৌঁছায় ৮২.৮০ টাকায়।

তদন্তে নেমেছে বিএসইসি

অস্বাভাবিক এই মূল্যবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করতে বিএসইসির মার্কেট ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়।
তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মো. গোলাম কিবরিয়া এবং সহকারী পরিচালক মো. মোসাব্বির আল আশিক।

কমিটিকে বলা হয়েছে, সম্পদ বিক্রির প্রকৃত উদ্দেশ্য, এর পেছনে থাকা আর্থিক ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত, এবং দাম বাড়ার সঙ্গে এর সম্পর্ক খুঁজে বের করতে। বিশেষ করে প্রশ্ন উঠেছে—ভিতরের কেউ কি আগেভাগেই খবর পেয়ে মুনাফা লুটেছে?

বিএসইসির ভাষ্যে যা বলা হয়েছে

বিএসইসি জানিয়েছে,

“পুঁজিবাজার ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আমরা নেটওয়ার্ক লিমিটেডের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রয়োজন। ডেটা সেন্টার বিক্রির মাধ্যমে কেউ ভেতরে থেকে বাজারকে প্রভাবিত করেছে কি না, তা বের করে আনতে হবে।”

কোম্পানির সর্বশেষ আর্থিক চিত্র

আমরা নেটওয়ার্ক সর্বশেষ হিসাববছর ২০২৪–এর জন্য ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এ বছর শেয়ারপ্রতি আয় (EPS) হয়েছে ২.৪৬ টাকা, আগের বছর ছিল ২.৪৩ টাকা। শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (NAVPS) দাঁড়িয়েছে ৩৭.০১ টাকা।

 শেয়ার মালিকানা ও কোম্পানির প্রোফাইল

আমরা নেটওয়ার্ক ২০১৭ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় এবং বর্তমানে 'জেড' ক্যাটাগরিতে রয়েছে। কোম্পানির মোট পরিশোধিত মূলধন ৯২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।
৩১ মে, ২০২৫ পর্যন্ত কোম্পানির শেয়ারের মালিকানার চিত্র এমন—

  • উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে: ৩৩.০৪%

  • প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী: ২১.৭১%

  • সাধারণ বিনিয়োগকারী: ৪৫.২৫%

কোম্পানির ওপর ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার স্বল্পমেয়াদি ঋণ এবং ১৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকার দীর্ঘমেয়াদি ঋণের বোঝা রয়েছে। সর্বশেষ ৩ জুলাই লেনদেন হয়েছে মাত্র ১৭.২০ টাকায়।

 ৫ বছরেও লাভ দেয়নি ডেটা সেন্টার!

কোম্পানিটি ২০১৭ সালে আইপিওর মাধ্যমে ৫৬ কোটি টাকার অধিক মূলধন সংগ্রহ করে জানিয়েছিল—এই অর্থ দিয়ে ডেটা সেন্টার তৈরি হবে। কিন্তু ৫ বছরেও সেটি লাভজনক হয়নি। অবশেষে সেটি বিক্রি করে দেওয়া হয় কোম্পানিরই এক অঙ্গপ্রতিষ্ঠানকে!

 বিশ্লেষকরা যা বলছেন

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন,

“এই ধরনের সম্পদ বিক্রি ও মূল্যবৃদ্ধি যদি পূর্বপরিকল্পিত হয়, তবে তা পুঁজিবাজারের জন্য ভয়ংকর বার্তা। তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।”

শেষ কথা

ডেটা সেন্টার বিক্রির ঘটনাটি এখন শুধুই আর্থিক লেনদেন নয়—এটি হয়ে উঠেছে বাজারের নৈতিকতা, স্বচ্ছতা ও বিনিয়োগকারীর নিরাপত্তার প্রশ্ন। তদন্তে সত্য বের হলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা প্রতিরোধে এটি নজির হয়ে থাকবে।