
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীর মতামত ও অভিজ্ঞতা এখনও নীতিনির্ধারণ বা বাজার তদারকির কাঠামোর অংশ হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ বিনিয়োগকারীরাই বাজারের প্রাণ এবং তাদের অনুভব, আস্থা ও অভিজ্ঞতা বাজারের বাস্তবতা তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর আস্থা ও অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিয়ে গঠিত হয়েছে দুটি শক্তিশালী ধারণা- আস্থা সূচক (Investor Sentiment Index) এবং সার্ভিস রেটিং (Service Rating System)। বাংলাদেশেও এই দুই ব্যবস্থা চালু করা হলে বাজারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আস্থা ফিরে আসবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যায়।
আস্থা সূচক; বিনিয়োগকারীর মনস্তত্ত্ব বুঝে বাজার বিশ্লেষণের আধুনিক পদ্ধতিঃ আস্থা সূচক বা Investor Sentiment Index হল এমন একটি পরিমাপ ব্যবস্থা যা বিনিয়োগকারীদের ভবিষ্যৎ বাজার সম্পর্কে প্রত্যাশা, আত্মবিশ্বাস এবং আচরণগত প্রবণতা নির্ণয় করে। যুক্তরাষ্ট্রের AAII (American Association of Individual Investors) প্রতি সপ্তাহে একটি সহজ জরিপের মাধ্যমে জানে, কতজন বিনিয়োগকারী বুলিশ, বিয়ারিশ বা নিরপেক্ষ মনোভাব পোষণ করছেন। এই সূচক বাজার বিশ্লেষণ, ফান্ড ম্যানেজমেন্ট এবং নীতিনির্ধারণে কার্যকর রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ভারতে SEBI ও NSE “Investor Perception Survey” পরিচালনা করে যেখানে অংশগ্রহণকারীদের মাধ্যমে বাজারে আস্থা, নীতিমালার প্রতিক্রিয়া ও আইপিও গ্রহণযোগ্যতার পরিমাপ করা হয়। সিঙ্গাপুর, হংকং এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতেও বিনিয়োগকারী আস্থাকে পরিমাপ করে মাসিক বা ত্রৈমাসিক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়, যা আন্তর্জাতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্তে সহায়তা করে।
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের সূচক নেই, অথচ এখানে প্রায় ১.৭ মিলিয়ন বিও অ্যাকাউন্টধারী রয়েছেন— যাদের অনুভব, মতামত ও প্রত্যাশা পুরো বাজারের দিকনির্দেশনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যদি BSEC বা স্টক এক্সচেঞ্জ সাপ্তাহিক বা মাসিক ভিত্তিতে ৩–৫টি প্রশ্নে একটি ডিজিটাল জরিপ চালায় এবং সেগুলোর ভিত্তিতে “Retail Investor Sentiment Index (RISI)” প্রকাশ করে— তবে বাজার সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত ও ব্যাখ্যা হবে অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত।
সার্ভিস রেটিং; বিনিয়োগকারীর অভিজ্ঞতা ও সন্তুষ্টির প্রতিবিম্বঃ বিনিয়োগকারীরা শুধু শেয়ার কেনা-বেচা করেন না, তারা এক বা একাধিক ব্রোকারেজ হাউজ ও স্টক এক্সচেঞ্জের সেবা গ্রহণ করেন। কিন্তু এই সেবার মানের পরিমাপে তাদের কোনো রেটিং ব্যবস্থা নেই। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে FINRA, ভারতে NSE/BSE ও যুক্তরাজ্যে FCA-এর অধীনে বিনিয়োগকারী অভিজ্ঞতা যাচাইয়ে বিভিন্ন রেটিং ব্যবস্থা রয়েছে। এসব ব্যবস্থায় সেবাগ্রহীতারা তাঁদের ব্রোকার, ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম, কাস্টমার কেয়ার, রিপোর্টিং সিস্টেম— এসব বিষয়ে নির্ধারিত ফরম্যাটে মতামত দেন এবং সেই ভিত্তিতে একটি সার্ভিস রেটিং নির্ধারণ হয়।
বাংলাদেশেও এমন একটি রেটিং ব্যবস্থা চালু করা সময়ের দাবি, যেখানে বিনিয়োগকারীরা মাসিক বা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে নিজ নিজ ব্রোকারেজ হাউজ, ট্রেডিং অ্যাপ, স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য সেবা, IPO আবেদন প্রক্রিয়া, ট্রান্সপারেন্সি ও অভিযোগ নিষ্পত্তির সময়কাল— এসব বিষয়ের উপর রেটিং দিতে পারবেন। একটি সার্বজনীন “Investor Service Rating Dashboard” চালু হলে ভালো সেবা প্রদানকারীদের স্বীকৃতি যেমন মিলবে, তেমনি দুর্বল সেবা প্রদানকারীরা নিজেরাই উন্নয়নের পথে এগোবে।
বাজারে সম্ভাব্য ইতিবাচক প্রভাবঃ
·আস্থা বৃদ্ধি পাবেঃ বিনিয়োগকারীদের মতামতের প্রতিফলন হলে বাজারে অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের মতামতকে মূল্যবান মনে করবেন। এতে পুঁজিবাজারে আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
· নীতিনির্ধারণ হবে তথ্যভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলকঃ আগাম প্রতিক্রিয়া জানার কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
· সেবার মান বৃদ্ধি পাবেঃ সার্ভিস রেটিং চালু হলে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে এবং মানসম্পন্ন সেবা নিশ্চিত হবে।
·বাজারে গুজব নির্ভর আচরণ হ্রাস পাবেঃ যখন বিনিয়োগকারী বুঝবে তার মতামত সরাসরি বাজার বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন বাজারে যুক্তিভিত্তিক আচরণ বৃদ্ধি পাবে।
· বিদেশি বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়বেঃ একটি সুশৃঙ্খল, অংশগ্রহণমূলক, প্রযুক্তিনির্ভর বাজার কাঠামো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
আধুনিক পুঁজিবাজার কেবলমাত্র সংখ্যা ও লেনদেনের উপর নির্ভর করে না— এটি বিনিয়োগকারীদের অনুভব, অভিজ্ঞতা ও মতামতের সম্মিলিত প্রতিফলন। বাংলাদেশে এখন সময় এসেছে সেই অনুভবকে স্বীকৃতি দেওয়ার, তাদের কণ্ঠস্বরকে নীতিনির্ধারণে যুক্ত করার। “আস্থা সূচক” এবং “সার্ভিস রেটিং” ব্যবস্থা চালু করলে কেবল বাজারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে না, বরং বাজারে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কৃতির সূচনা ঘটবে। এটি হবে ভবিষ্যতের জন্য একটি সাহসী, টেকসই ও প্রগতিশীল পদক্ষেপ।
লেখক:
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক