ঢাকা   বুধবার ২১ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিনিয়োগ সন্ত্রাসই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর অনাস্থার অন্যতম কারণ

শেয়ার বিজনেস কী?

সাইফুল ইসলাম পিপন 

প্রকাশিত: ১৫:৫৬, ২১ মে ২০২৫

আপডেট: ১৬:০০, ২১ মে ২০২৫

বিনিয়োগ সন্ত্রাসই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর অনাস্থার অন্যতম কারণ

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে আস্থা সংকট দিনদিন ঘনীভূত হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের বিশাল একটি অংশ হতাশা, ক্ষতি ও বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন বারবার। অথচ বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি রয়েছে কয়েক শতাধিক, অর্থনীতির আকার ক্রমশ বাড়ছে এবং বিনিয়োগে আগ্রহও কম নয়। প্রশ্ন হলো— তবুও কেন বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন? এর পেছনে একাধিক কারণ থাকলেও একটি ভয়াবহ বাস্তবতা হচ্ছে “বিনিয়োগ সন্ত্রাস”। এই অদৃশ্য ও কৌশলগত সন্ত্রাসই বিনিয়োগকারীর আস্থার সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হয়েছে।

 
বিনিয়োগ সন্ত্রাস বলতে বোঝায়— এমন একটি অদৃশ্য চক্র বা গোষ্ঠী, যারা নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে, আইনের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে, সাধারণ বিনিয়োগকারীর উপর ফাঁদ পেতে নিজেরা লাভবান হয়। এরা কখনো ইনসাইডার তথ্য ব্যবহার করে শেয়ার মূল্যের কৃত্রিম উত্থান ঘটায়, আবার কখনো সামাজিক মাধ্যমে বা এজেন্ট দিয়ে গুজব ছড়িয়ে শেয়ার বিক্রি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীকে নিঃস্ব করে।

আইপিও-তে বিনিয়োগ সন্ত্রাসঃ

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, পুঁজিবাজারে নতুন শেয়ার তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে নানাবিধ অনিয়ম ও সিন্ডিকেট ইনফ্লুয়েন্স, এছাড়াও তালিকাভুক্তির পর বেশ কয়েকদিন উক্ত শেয়ারের বিশাল কৃত্রিম চাহিদা এবং উচ্চদামে লেনদেন লক্ষনীয়। কিন্তু পরবর্তীতে শেয়ারটির মূল্য দ্রুত পড়ে যায় এবং সাধারণ বিনিয়োগকারী যখন লভ্যাংশের আশায় বা ট্রেডের মুনাফার আশায় কিনে বসেন, তখন তারা আটকে যান দীর্ঘমেয়াদি লোকসানে। এসকল প্রক্রিয়া শুধুমাত্র ফান্ডামেন্টালহীন কোম্পানিগুলোর বেলায় ঘটে না, বরং কিছু স্বীকৃত কোম্পানির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে অসাধু এই সিন্ডিকেটের সক্রিয়তা, এটি এক ধরনের “প্রি-প্ল্যানড ডাম্পিং”। তাছাড়াও, “আইপিও পার্টি বা আইপিও সিন্ডিকেট” নামক একদল মানুষ আইপিও-র সুবাতাসে বাজারে প্রবেশ করে, যারা নামে বেনামে কয়েকশত থেকে কয়েক হাজার একাউন্টে আইপিও আবেদন করে এবং অল্প দিনের মধ্যে একটা বড় লভ্যাংশ বাজার থেকে তুলে নিয়ে যায়। পক্ষান্তরে, বাজারের প্রকৃত বিনিয়োগকারীগণ আইপিও শেয়ার কম পায় এবং সীমিত লাভবান হয়, যদিও লটারির পরিবর্তে শেয়ার বন্টন ও বাধ্যতামূলক বিনিয়োগ নিয়মের কারণে এই সিন্ডিকেট বর্তমানে দুর্বল হয়ে পড়েছে।

ইনসাইডার ট্রেডিং ও রেইডিং সিন্ডিকেটঃ

ইনসাইডার ট্রেডিং মানে হচ্ছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে শেয়ার কেনাবেচা, যা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জানার সুযোগ নেই। এ ধরনের তথ্যভিত্তিক অগ্রাধিকার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির কারণ হয় এবং বাজারে অস্বচ্ছতা তৈরি করে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে একাধিক কোম্পানির বেলায় পরিচালক ও প্রভাবশালী শেয়ারহোল্ডারদের আচরণ বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, অনেক সময় তারা পূর্ব পরিকল্পনায় শেয়ার দাম বাড়িয়ে পরে তা সাধারণের কাঁধে চাপিয়ে দেয়। এতে একদিকে বাজারে হঠাৎ অস্থিরতা আসে, অন্যদিকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর ওপর ধ্বংসাত্মক চাপ পড়ে।

গ্যাম্বলিং সংস্কৃতি এবং এর ধর্মীয়-রাষ্ট্রীয় অবস্থানঃ

পুঁজিবাজার কখনোই জুয়ার জায়গা নয়, এটি একটি স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্র। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের একটা বড় অংশের বিনিয়োগকারী জেনে বা না জেনে বিনিয়োগ নিয়ম-নীতিকে অবজ্ঞা করে রাতারাতি সর্বোচ্চ মুনাফা আশা করেন। এ ধরনের মানসিকতা শুধু তাদের ক্ষতির দিকেই ঠেলে দেয় না, বরং বাজারে জুয়া সংস্কৃতিরও জন্ম দেয়। এধরণের জুয়ায় অংশ নেওয়া প্রথম সারির কিছু বড় বিনিয়োগকারী লাভবান হলেও অধিকাংশ বিনিয়োগকারী দিনশেষে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং অনাস্থার সৃষ্টি করে। ইসলাম ধর্মে গ্যাম্বলিং বা জুয়াকে স্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে, এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেও গ্যাম্বলিং বা জুয়া নিষিদ্ধ তথা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ কিছু তথাকথিত গ্যাম্বলার বাজারে এখনো সুপরিচিত এবং তাদের কার্যক্রম বিশেষভাবে লক্ষনীয়, যারা ইনফ্লুয়েন্সার ও সামাজিক মাধ্যমের গ্রুপ বা পেইজ এডমিনদের সাথে মিলিত হয়ে সরাসরি শেয়ার ট্রেডের পরামর্শ দেয় এবং এটি স্পষ্টভাবে এক ধরনের গেম্বলিংয়ে পরিণত হয়। বিনিয়োগ নয়, এটি হচ্ছে একপ্রকার “ধর্মঘাতী ও রাষ্ট্রীয় আইন অমান্যের বাজিকর কার্যক্রম”।

গুজব নির্ভর বাজার প্রবণতাঃ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ভুয়া তথ্য, গুজব এবং কৃত্রিম হাইপ তৈরির প্রয়াস চালানো হয়। এক্ষেত্রে গুজব সিন্ডিকেট সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে শেয়ার হাতিয়ে নেওয়ার জন্য নেতিবাচক গুজব ছড়ায় এবং কম দামে শেয়ার কিনে নেয়, অপরদিকে ইতিবাচক গুজব ছড়িয়ে বেশি দামে সাধারণ বিনিয়োগকারীর হাতে শেয়ার ধরিয়ে দেয়। দুই ক্ষেত্রেই সাধারণ বিনিয়োগকারী একটা বড় লোকসানের শিকার হয়। কেউ বলেন “অমুক কোম্পানির ব্যালেন্স শিট দুর্দান্ত”— কিন্তু মূলত সেখানে আয় কমেছে, দেনা বেড়েছে। কেউ বলেন “বড় ইনভেস্টর/ বিদেশি ইনভেস্টর আসছে”— কিন্তু পরে দেখা যায়, শুধু গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে লেনদেন গরম করে রাখা হয়েছে। এই সংস্কৃতির পেছনে দায়ী কিছু স্বার্থান্বেষী দল বা গুজব সিন্ডিকেট, যাদের উদ্দেশ্যই হলো গুজব তৈরি করে স্বল্পমেয়াদে বাজারে কৃত্রিম চাপ সৃষ্টি করা।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার সীমাবদ্ধতা ও বিনিয়োগকারীর ক্ষোভঃ

বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জগুলো মাঝে মাঝে কিছু কোম্পানির শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা অপর্যাপ্ত, ধীরগতির এবং প্রভাবহীন। অনেকে মনে করেন, এই শাস্তিগুলো আসলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারে না। বরং ইনসাইডারদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান, অটোমেটেড নজরদারি ব্যবস্থা এবং গুজবপ্রবণতা রোধে মিডিয়া মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

আস্থার সংকটের প্রভাবঃ

পুঁজিবাজারে আস্থার সংকট মানেই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ঘাটতি, লেনদেনের পরিমাণ হ্রাস এবং বাজারে টেকসই মূলধন সৃষ্টির ব্যর্থতা। যখন বিনিয়োগকারীরা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হন, তখন তারা বাজারে ফিরতে চান না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এমন একটি বাজারে পুঁজিবিনিয়োগ করতে দ্বিধা করেন, যেখানে আস্থা, স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে হয়তো এবং পুরো অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এভাবেই বিনিয়োগ সন্ত্রাস কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কাঠামো দুর্বল করে দেয়।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটঃ

উন্নত দেশগুলোতে পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও বিনিয়োগ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কঠোর আইন ও প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (SEC) “মার্কেট অ্যাবিউজ” বা ইনসাইডার ট্রেডিং শনাক্ত করতে অত্যাধুনিক অ্যালগরিদমিক মনিটরিং সিস্টেম ব্যবহার করে, যা প্রতিদিন লক্ষাধিক ট্রেডিং কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে সন্দেহজনক লেনদেন চিহ্নিত করে। ভারতে SEBI নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে প্রতিটি কোম্পানিকে করপোরেট ঘোষণা এবং ইনসাইডার লেনদেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আপডেট করার বাধ্যবাধকতা দিয়েছে। এছাড়া “Prohibition of Fraudulent and Unfair Trade Practices” রেগুলেশন অনুযায়ী গুজব ছড়ানো ও কৃত্রিম হাইপ তৈরিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। মালয়েশিয়ার মতো দেশে পুঁজিবাজারে গ্যাম্বলিং সন্দেহভাজন অ্যাকাউন্টগুলো নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাৎক্ষণিক ও সরাসরি ট্রেডিং স্থগিত করে তদন্ত শুরু করে। এছাড়াও, যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (SEC) বিনিয়োগকারীদের “গ্যাম্বলিং-ধর্মী” আচরণ শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত সক্রিয়। রিটেইল ট্রেডারদের মধ্যে FOMO, Meme Stock Buying এবং Short Squeeze প্রবণতা যখন বিপজ্জনক রূপ নেয়— SEC তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত শুরু করে এবং প্রয়োজন হলে বিশেষ “Trading Halt” আরোপ করে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালে GameStop ও AMC শেয়ার নিয়ে গ্যাম্বলিং টাইপ ট্রেডিং আচরণ ছড়ানোর সময় SEC ও FINRA মার্কেট মনিপুলেশন সন্দেহে ব্যাপক তদন্ত করে এবং রবিনহুড ও অন্যান্য ট্রেডিং অ্যাপকে নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য করে। এসব উদাহরণ বাংলাদেশেও প্রয়োগযোগ্য হতে পারে— যেখানে স্বয়ংক্রিয় সতর্কবার্তা, মিডিয়া মনিটরিং এবং ইনসাইডার রিপোর্টিং স্বচ্ছতা, গোপনীয়তা নিশ্চিত ও বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে বিনিয়োগ সন্ত্রাস দমন সম্ভব।

পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য আস্থা সবচেয়ে বড় সম্পদ। বিনিয়োগ সন্ত্রাস, ইনসাইডার ট্রেডিং, গ্যাম্বলিং সংস্কৃতি এবং গুজব এই আস্থাকে ধ্বংস করছে। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে শত শত সচেতন বিনিয়োগকারী বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে এবং নতুন বিনিয়োগকারীর আগমন ঘটবেনা পুঁজিবাজারে। রাষ্ট্র ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত এখনই বিনিয়োগ সন্ত্রাসকে চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, পাশাপাশি বিনিয়োগ শিক্ষা ও তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। তাহলেই হয়তো পুঁজিবাজারে দ্রুত প্রাণ ফিরে আসবে এবং হয়ে উঠবে দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চালিকাশক্তি।

 
লেখক : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক