ঢাকা   শনিবার ৩১ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

নিঃসঙ্গ পথের কাব্য: সাইকেলে ১২ দিনে আবিষ্কৃত এক ভিন্ন আর্জেন্টিনা

ভ্রমণ

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১৮:৫৯, ২৯ মে ২০২৫

নিঃসঙ্গ পথের কাব্য: সাইকেলে ১২ দিনে আবিষ্কৃত এক ভিন্ন আর্জেন্টিনা

ফুটবলের দেশ, আন্দিজের চূড়া কিংবা বুয়েনস এইরেসের গ্ল্যামার—এসব নিয়েই ছিল কল্পনার আর্জেন্টিনা। কিন্তু বাস্তবে যা দেখেছি, তা যেন এক ভিন্ন পৃথিবী। সাইকেলের প্যাডেলে ১২ দিন ধরে ছুঁয়ে দেখা সেই আর্জেন্টিনা ছিল পাতাগোনিয়ার শূন্য উপত্যকা, নির্জন রাস্তা, কুয়াশায় ঢাকা পাহাড় আর মানুষের মুখে খাঁটি অথচ সংযত বন্ধুত্বের গল্প।

সফর শুরু হয়েছিল আন্দিজের পাদদেশে অবস্থিত বারিলোচে শহর থেকে, যাকে বলা হয় 'সুইজারল্যান্ড অব আর্জেন্টিনা'। প্রকৃতি এখানে তার নিখুঁত রূপে ধরা দেয়—লেক, পাহাড় আর সুইস ধাঁচের ঘরবাড়ি। এখান থেকে যাত্রা শুরু করে, সাইকেলে করে অতিক্রম করেছি ভিয়েদমা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ মরুভূমি, ক্যানভাসের মতো ছড়িয়ে থাকা ধুলোময় ভূদৃশ্য আর সীমাহীন নীরবতা।

এই যাত্রায় কেবল প্রকৃতি নয়, মানুষের মুখও ছিল অনন্য অভিজ্ঞতা। কুকুরের ডাক, পাহাড় ঘুরে আসা প্রতিধ্বনি, নির্জন গ্রামে রাত্রিযাপন, স্কুলের শিশুরা আর সেই আদিবাসী—যার হাতে আরবি ও হিব্রু হরফের উল্কি। যেন এক অদৃশ্য ইতিহাস আমাকে ধরা দিচ্ছে স্তরে স্তরে।

কুমালকাম নামের এক গ্রামে দেখা মিলল পর্যটনের অংশ হিসেবে চালু পুরোনো স্টিম ট্রেনের, যা এক পলকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল অতীতে। আবার ক্লেমেন্তে অর্নেলি নামের জায়গায়, যেখানে থাকার জায়গা নেই, সেখানেও মানুষের আন্তরিকতা সব অসুবিধা মুছে দিল। স্কুলে রাত কাটানো, শিশুদের সঙ্গে বাংলাদেশের গল্প ভাগাভাগি করা আর তাঁদের কৌতূহলী চোখে দেখা আমার ছোট্ট পতাকাটি—এই সব মুহূর্ত হৃদয়ে গেঁথে রইল।

আর্জেন্টিনায় মানুষ আমাদের মতো অত সহজে এগিয়ে এসে গল্প শুরু করে না, কিন্তু প্রয়োজন হলে পাশে দাঁড়ায়। যেমন একদল মানুষ যখন সাইকেল বাসে তুলতে দেওয়া হয়নি, তখন তাঁরা নিজের গাড়িতে তুলে ভিয়েদমা পৌঁছে দিলেন। শুধু পৌঁছেই নয়, বিদায়ের সময় উপহার দিলেন তাঁদের জাতীয় পতাকা—আরও একবার প্রমাণ করলেন, সংস্কৃতি ও ভাষা ভিন্ন হলেও মানবিকতা একই।

পথের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি নিঃসঙ্গ সকাল, প্রতিটি বাতাসের ধাক্কা আমাকে শিখিয়েছে—আসল সংযোগ চোখে দেখা নয়, মন থেকে অনুভব করা। এই যাত্রায় আমার সঙ্গে ছিল বাংলাদেশের পতাকা। কেউ থামিয়ে জানতে চায়নি কোথাকার, কেউ চা দেয়নি হাতে। কিন্তু তাতে ভালোবাসার মান কমে না। বরং সম্পর্কের গভীরতা বোঝা যায় নীরবতার মধ্য দিয়ে।

শেষে যখন পৌঁছালাম ভিয়েদমা, তখন বুঝলাম—এই যাত্রার আসল পাওয়া কী। শুধু পা নয়, মনও চলে গেছে অনেক দূর। বুঝেছি, ভালোবাসা একতরফা মনে হলেও, সেই সম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লাগে। আর এই সাইকেলযাত্রাই ছিল সেই সময়ের এক দীর্ঘ প্রস্তুতি—যা দিয়ে দুটো দেশের বন্ধন একদিন আরও গভীর হবে, হয়তো নিঃশব্দেই।