ঢাকা   সোমবার ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ২৭ আশ্বিন ১৪৩২

লাভেলোর মুনাফা বাড়ল চোখে পড়ার মতো—পেছনে কী রহস্য?

শেয়ারবাজার

শেয়ারবিজনেস ডেস্ক

প্রকাশিত: ২১:১৮, ১২ অক্টোবর ২০২৫

লাভেলোর মুনাফা বাড়ল চোখে পড়ার মতো—পেছনে কী রহস্য?

 শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত লাভেলো আইসক্রীম আবারও তুমুল আলোচনায়। কোম্পানিটি ২০২৫ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য শেয়ারহোল্ডারদের ১৬ শতাংশ ডিভিডেন্ড ঘোষণা করেছে। এরমধ্যে ১১ শতাংশ ক্যাশ ও ৫ শতাংশ বোনাস। আগের বছর কোম্পানিটি দিয়েছিল ২০ শতাংশ ডিভিডেন্ড। যার মধ্যে ছিল ১০ শতাংশ ক্যাশ ও ১০ শতাংশ বোনাস।

তবে মূল উদ্বেগ ডিভিডেন্ডে নয়—বরং কোম্পানির আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠছে।


তৃতীয় প্রান্তিকে ধস, চতুর্থ প্রান্তিকে স্থবিরতা, পরের প্রান্তিকেউল্লম্ফন


লাভেলোর আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি–মার্চ) কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) নেমে আসে ২২ পয়সায়, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৭১ পয়সা।

চতুর্থ প্রান্তিকে পরিস্থিতি আরও দুর্বল হয়—বছরজুড়ে ইপিএস দাঁড়ায় ১ টাকা ৬৫ পয়সা, অর্থাৎ শেষ প্রান্তিকে কোম্পানির আয় মাত্র ৬ পয়সা।

অর্থাৎ, তৃতীয় ও চতুর্থ প্রান্তিকে কোম্পানির আয় প্রায় স্থবির অবস্থায় চলে যায়। তারপর হঠাৎই ইপিএসে উল্লম্ফন—এখানেই প্রশ্ন বিনিয়োগকারীদের

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কোম্পানিটি এবছর মাত্র ১১ দিনের মাথায় (সেপ্টেম্বর শেষ) প্রথম প্রান্তিকের (জুলাই–সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে—যেখানে হঠাৎ করেই ইপিএস দেখানো হয়েছে ১ টাকা ২ পয়সা।এমন প্রবৃদ্ধি প্রশ্ন উঠেছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে—যেখানে আগের দুই প্রান্তিকে আয় ছিল প্রায় স্থির, সেখানে নতুন অর্থবছরের শুরুতেই এমন ‘অলৌকিক’ বৃদ্ধি কীভাবে সম্ভব?


বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি হতে পারে মূল্য সংবেদনশীল তথ্যের (পিএসআই) মাধ্যমে শেয়ারদর বাড়ানোর একটি প্রচেষ্টা।

একজন সিনিয়র বিশ্লেষক বলেন, “যে কোম্পানি সাত মাসেও তৃতীয় প্রান্তিকের হিসাব দিতে পারেনি, তারা ১১ দিনের মধ্যে প্রথম প্রান্তিকের প্রতিবেদন প্রকাশ করে কী বার্তা দিতে চায়—এটাই এখন বড় প্রশ্ন।”

বিএসইসির হস্তক্ষেপ ও তদন্তাধীনশেয়ার কারসাজি

এর আগে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে শেয়ার কারসাজির অভিযোগে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) লাভেলো-সম্পৃক্ত তিনটি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টের ডেবিট লেনদেন (বিক্রয়) ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেছে।

বিএসইসি ডিএসই, সিএসই ও সিডিবিএলকে চিঠি দিয়ে নির্দেশ দিয়েছে, এসব অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো শেয়ার বিক্রি করা যাবে না—বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষার স্বার্থে।


এই সিদ্ধান্তের পর থেকেই লাভেলোর শেয়ার নিয়ে বাজারে নতুন করে সন্দেহ দানা বেঁধেছে।

আর্থিক গরমিল ও ‘রিস্টেটেড’ প্রতিবেদন

অন্যদিকে, কোম্পানিটি সম্প্রতি তাদের আগের বছরের (২০২৪) আর্থিক প্রতিবেদন রিস্টেট বা সংশোধন করেছে।

আগে কোম্পানির নিট সম্পদমূল্য (এনএভি) দেখানো হয়েছিল ১১৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, তবে সংশোধনের পর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকায়। অর্থাৎ, আগের প্রতিবেদনে সম্পদের পরিমাণ বেশি দেখিয়েছিল—যা ইঙ্গিত দেয় যে কোম্পানিট আগে সম্পদের পরিমাণ অতিরঞ্জিত দেখিয়েছে।

বাজারে আস্থাহীনতা বাড়ছে

শেয়ারবাজারে লাভেলোর প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ একসময় প্রবল ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কোম্পানির মালিকদের শেয়ার কারসাজিতে সম্পৃক্ততা এবং কোম্পানিটির আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি শেয়ারবাজারে লাভেলো আইসক্রীমের বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান তৌফিকা ফুড অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের লেনদেন শুরু হয়। ওইদিন ২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি আয় প্রকাশ করা হয় ১ টাকা ২০ পয়সা এবং সম্পদ মূল্য দেখানো হয় ১২ টাকা ১৭ পয়সা।

এরপর আর কোন প্রান্তিকেই কোম্পানিটি ১ টাকার ওপরে মুনাফা ছুঁতে পারেনি। তালিকাভুক্তির পর কোম্পানিটি এবারই চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রেকর্ড মুনাফা দেখালো।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বারবার প্রতিবেদন সংশোধন, প্রান্তিক ইপিএসে অস্বাভাবিক ওঠানামা, শেয়ার নিয়ে দফা দফায় কারসাজি এবং সর্বোপরি বিএসইসির শাস্তি—সব মিলিয়ে কোম্পানিটির ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।