
“প্রতিশোধ নিলে, আমরা কীভাবে ওদের চেয়ে ভালো হলাম?”—এই প্রশ্ন করে ক্ষমা, শান্তি আর সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। ১৯৯৪ সালের ১০ মে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি। ঐতিহাসিক ওই দিনে রাজধানী প্রিটোরিয়ার ইউনিয়ন ভবনের এম্ফিথিয়েটারে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশ্বের ১৪০টির বেশি দেশের প্রতিনিধিদের সামনে তিনি বলেছিলেন, “সবার জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করি, সবার জন্য শান্তি বজায় রাখি। এই ভূমি আর কখনোই নিপীড়নের মুখোমুখি হবে না।”
ম্যান্ডেলার প্রেসিডেন্ট হওয়া ছিল এক ঐতিহাসিক বিজয়, কেননা তিনি দীর্ঘ ২৭ বছর কারাভোগ করে ফিরেছিলেন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হয়ে। তাঁর নেতৃত্বেই দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের জয় হয়, বিলুপ্ত হয় চরম বৈষম্যমূলক আইন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গদের নিয়ন্ত্রিত ন্যাশনাল পার্টির ক্ষমতার অবসান ঘটে ১৯৯৪ সালের ২৭ এপ্রিলের নির্বাচনে। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি) পায় ২৫২টি আসন, আর ম্যান্ডেলা জয়ী হয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট হন।
রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে ম্যান্ডেলার বড় পদক্ষেপ ছিল ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ কমিশনের গঠন। এই কমিশন ১৯৬০–১৯৯৪ সময়কালে সংঘটিত বর্ণবাদী নিপীড়নের তদন্ত করে এবং জাতিগত বিভাজন নিরাময়ে উদাহরণ সৃষ্টি করে।
১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই কেপটাউনের কুনু গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নেলসন রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা। সবাই তাঁকে ভালোবেসে ‘মাদিবা’ নামে ডাকত, যার অর্থ ‘জাতির জনক’। তিনি ১৯৪৪ সালে এএনসিতে যোগ দেন এবং রাজপথে প্রতিবাদের মাধ্যমে হয়ে ওঠেন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ।
১৯৬০ সালের ‘শার্পভিল হত্যাকাণ্ড’-এর পর দক্ষিণ আফ্রিকায় জরুরি অবস্থা জারি হলে ম্যান্ডেলাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি বিদেশে গিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে সমর্থন আদায় করেন ও সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। দেশে ফিরে ১৯৬2 সালে পুনরায় গ্রেপ্তার হন। এরপর ‘রিভোনিয়া মামলা’য় দোষী সাব্যস্ত হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। তাঁর ১৮ বছরের জেলজীবনের বড় সময় কেটেছে রোবেন দ্বীপে।
ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে বিশ্বজুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ডি ক্লার্ক বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘোষণা করেন এবং ১১ ফেব্রুয়ারি ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তির পর টাউন হলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ম্যান্ডেলা বলেন, “আমরা স্বপ্ন দেখি এমন একটি সমাজের, যেখানে সবাই সমান অধিকার নিয়ে বাস করবে।”
ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে ১৯৯৪ সালের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এএনসি অভাবনীয় বিজয় অর্জন করে। তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তাঁর জীবনের ওপর নির্মিত হয় “Mandela: Long Walk to Freedom” চলচ্চিত্র, যেটি তাঁর আত্মজীবনী থেকে অনুপ্রাণিত। এই চলচ্চিত্রে তাঁর শান্তির বার্তা ও ক্ষমার দর্শন স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
১৯৯৩ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান ম্যান্ডেলা ও ডি ক্লার্ক। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে রাজনীতি থেকে অবসর নেন তিনি। তাঁর সরকার ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে, যেখানে মানবাধিকার, সমতা ও আইনের শাসনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।
ম্যান্ডেলা কেবল রাষ্ট্রনেতা ছিলেন না, ছিলেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের আশা ও সাহসের নাম। ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর জোহানেসবার্গে ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার আগ পর্যন্ত কাজ করে গেছেন শান্তি, শিশু অধিকার ও বিশ্ব মানবতার পক্ষে।