শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণের ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে। নিয়মনীতি উপেক্ষা করে মাত্র ৩২ জন বড় গ্রাহককে বিশেষ সুবিধায় ঋণ দেওয়ার ফলেই ব্যাংকটির ১৪ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী একক কোনো গ্রুপকে ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়ার সুযোগ না থাকলেও বিশেষ অনুমোদনের মাধ্যমে সেই সীমা অতিক্রম করা হয়েছে।
নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংকটির ৪৭ জন গ্রাহককে মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছে, যাদের বড় ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৩২ জন গ্রাহকের কাছেই ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ৬৩ শতাংশ আটকে আছে। রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, এসব সমস্যাযুক্ত ঋণের বেশিরভাগই তাঁর দায়িত্ব নেওয়ার আগেই অনুমোদিত হয়েছিল। বর্তমানে ঋণ আদায়ে মামলা, পুনঃতফসিলসহ সব ধরনের আইনগত ও প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
খেলাপি ঋণের লাগামছাড়া বৃদ্ধিতে ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে শীর্ষ ১৬ খেলাপির কাছে ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৫ সালের জুনে এসে মোট খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ২২ হাজার ১৮০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৪৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বর নাগাদ এই হার আরও বেড়ে ৫১ শতাংশে, অর্থাৎ ২৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছেই মোট খেলাপি ঋণের ৫৫ শতাংশ আটকে রয়েছে।
ঋণ আদায়ের চিত্রও হতাশাজনক। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৭ শতাংশ বা ৯০ কোটি টাকা উদ্ধার করতে পেরেছে ব্যাংকটি। এতে করে তারল্য সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।
মূলধন পরিস্থিতি ব্যাংকটির সংকটের গভীরতা স্পষ্ট করে। জুন শেষে প্রয়োজনীয় মূলধন ছিল ৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা, অথচ প্রকৃত মূলধন নেমে গেছে ঋণাত্মক ১৩ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকায়। ফলে রূপালী ব্যাংকে বর্তমানে ২৩ হাজার ২৪০ কোটি টাকার বিশাল মূলধন ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
খেলাপি ঋণের তালিকায় রয়েছে দেশের প্রভাবশালী ও পরিচিত অনেক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ব্লু প্ল্যানেট গ্রুপ, বেক্সিমকো, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন, ক্রনি অ্যাপারেলস ও জুট টেক্সটাইল মিলস অন্যতম। পাশাপাশি এমএসএ টেক্সটাইল, ইউনিট্যাক্স গ্রুপ, নূরজাহান গ্রুপ, এএ নিট স্পিন, মাদারীপুর স্পিনিং ও ডলি কনস্ট্রাকশনসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছেও শত শত কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়ে আছে।
ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শাখাভিত্তিক অস্বাভাবিক কেন্দ্রীভবনও প্রশ্ন তুলেছে। সারা দেশে ৫৮৬টি শাখা থাকলেও মোট ঋণের ৫৫ শতাংশের বেশি দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫টি শাখা থেকে। এর মধ্যে শুধু ‘লোকাল অফিস’ শাখা থেকেই বিতরণ হয়েছে ৩৬ শতাংশ ঋণ। বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নির্দিষ্ট শাখা ব্যবহার করে বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, একক গ্রাহক সীমা নির্ধারণ করা হয় ঝুঁকি কমানোর জন্য। কিন্তু কর্মসংস্থান ও নিত্যপণ্যের সংকটের অজুহাতে বড় গ্রুপগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, যা এখন রূপালী ব্যাংকের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই প্রতিফলন হিসেবে ২০২৫ সালে ব্যাংকটির নিট সুদ আয় ৫৯৭ কোটি টাকা ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে।
























