ঢাকা   শনিবার ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২

"কলারোয়ার শতবর্ষী সন্দেশ, যার স্বাদ ভুলতে পারে না কেউ!"

গ্রামবাংলা

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২০:০৫, ৪ জুলাই ২০২৫

সর্বশেষ

খাঁটি গরুর দুধ, লেবুর টক পানি, চিনি আর নিষ্ঠা—এই চার উপাদানে তৈরি হয় সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বিখ্যাত সন্দেশ, যা স্থানীয়ভাবে ‘শংকর ঘোষের সন্দেশ’ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় শংকর ঘোষের দাদা শুরু করেছিলেন এই সন্দেশ তৈরির পেশা। পরে তাঁর বাবা কীষ্টপদ ঘোষ চালিয়ে যান সেই কাজ। বাবার পাশেই দাঁড়িয়ে শিখেছেন শংকর ঘোষ। চার দশক ধরে সেই রীতিতেই সন্দেশ তৈরি করছেন তিনি। এখন তাঁর দুই ছেলে রাজীব ও নিত্য ঘোষও আছেন সহযোগিতায়।

শংকর ঘোষের বাড়ি সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কয়লা ইউনিয়নের ঘোষপাড়া গ্রামে। একটি পুরোনো টিনের ঘরে প্রতিদিন সকাল থেকে তিনি সন্দেশ তৈরির কাজ করেন। কাঠের চুলায় দুধ জ্বাল দেওয়া, ছানা তৈরি আর কড়াই নাড়ার কাজটি নিজ হাতে করেন শংকর ঘোষ। শুধু মিষ্টি তৈরি নয়, টিকিয়ে রেখেছেন পারিবারিক এক পুরোনো ঐতিহ্য।

প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন শংকর ঘোষ ও তাঁর ছেলেরা। আশপাশের গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা হয় দুধ। তারপর শুরু হয় সন্দেশ তৈরির কয়েক ধাপের প্রক্রিয়া। প্রথমে দুধ ছেঁকে নেওয়া হয়, পরে কাঠের আগুনে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় ছানা। ছানা ঝুলিয়ে রাখা হয় পানি ঝরানোর জন্য। এরপর চিনি মিশিয়ে কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া হয় যতক্ষণ না সন্দেশ দানা বাঁধে। তারপর তা ঠান্ডা করে হাতে বা ছাঁচে তৈরি করা হয় আকৃতি। পুরো প্রক্রিয়াতেই কোনো রকম রাসায়নিক, রং বা ফ্লেভার ব্যবহৃত হয় না।

প্রতিদিন ২২ থেকে ২৫ কেজি সন্দেশ তৈরি করেন শংকর ঘোষ। প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ পড়ে ২০০ থেকে ২২০ টাকা, বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। এতে মাসে আয় হয় ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। সেই আয়েই চলে সংসার, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা। কলারোয়ার বিভিন্ন বাজারে বাজারে এই সন্দেশের নাম রয়েছে। দূরদূরান্তের মানুষ এই সন্দেশ কিনতে আসেন।

শংকর ঘোষ বলেন, ‘আমার দাদা ব্রিটিশ আমলে এই পেশা শুরু করেছিলেন। বাবাও এই পেশা আঁকড়ে রেখেছিলেন। আমি বাবার পাশেই দাঁড়িয়ে শিখেছি কীভাবে সন্দেশ তৈরি করতে হয়। কী করলে সুস্বাদু হয়। সন্দেশ মানে যে শুধু রান্না নয়, মন দিয়ে তৈরি করা একটা বিশেষ ধরনের মিষ্টি খাবার। অন্যদের চেয়ে আলাদা ও দামে সস্তা বলেই সবাই আমার সন্দেশের কদর করে।’

কথায় কথায় জানা গেল, পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া এ পেশার হাল ধরেছেন শংকর ঘোষ চার দশক আগে। তাঁর দুই ছেলেও এখন তাঁকে সহযোগিতা করেন। বড় ছেলে রাজীব ঘোষ দুধ সংগ্রহ করেন আর ছোট ছেলে নিত্য ঘোষ প্রতিদিন সকালে সাইকেলে করে কয়েকটি বাজারে নির্দিষ্ট দোকানে পাইকারি সন্দেশ বিক্রি করেন। তিনি কাঁধের হাঁড়িতে সন্দেশ নিয়ে হেঁটে উপজেলার কয়লা, রায়টা, বুইথা, কুমরনল, বৈইথা, রায়পুর, বাটরা, চৌরাস্তা, সিংহাল, ধানন্দিয়া ও জালালাবাদ বাজারে বিক্রি করেন।

রায়টা গ্রামের কৃষক পীর বক্স গাইন (৭০) জানান, শংকর ঘোষের বাবা কীষ্টপদ ঘোষের তৈরি সন্দেশ ছোটবেলা থেকে খেয়ে আসছেন। এখন সন্দেশ তৈরি করেন তাঁর ছেলে শংকর ঘোষ। স্বাদ ও বৈশিষ্ট্য আগের মতো রয়েছে। কয়লা গ্রামের গৃহবধূ ফেরদৌসা খাতুন বলেন, ‘অনেক জায়গার সন্দেশ খেয়েছি। কিন্তু শংকর কাকার হাতে বানানো মিষ্টির স্বাদ একেবারে আলাদা। আসল দুধের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।’

শংকর ঘোষ গণমাধ্যম কে বলেন, ‘অনেকে বলে, এতে লাভ কম। কিন্তু আমি বলি, সন্দেশ আমাকে পরিচিতি দিয়েছে। মানুষ আমাকে ভালোবাসে, এইটাই আমার বড় লাভ।’

হাতে তৈরি মিষ্টির বাজার দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। চারদিকে মেশিনে তৈরি, প্লাস্টিক মোড়ানো, কৃত্রিম ফ্লেভারযুক্ত মিষ্টির দাপট। দামও কম, চাহিদাও বেশি। কিন্তু শংকর ঘোষের মতো কিছু মানুষ এখনো হাতে তৈরি সন্দেশে টিকিয়ে রেখেছেন স্বাদ, গুণ ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য।

কয়লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল রানা গণমাধ্যম কে বলেন, শংকর ঘোষের সন্দেশ তাঁদের এলাকাকে পরিচিত করেছে। তাঁর সন্দেশের স্বাদই আলাদা। ছোট পরিসরে হলেও আন্তরিকতা, নিষ্ঠা আর ঐতিহ্য নিয়ে এই পরিবার যেভাবে কাজ করছে, এতে ছোট উদ্যোগও বড় স্বপ্ন বয়ে আনতে পারে, সেটা শিক্ষা দেয়। আজ গ্রামীণ অনেক শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে, সেখানে শংকর ঘোষের মতো কারিগরেরা দেখিয়ে দিচ্ছেন, বাংলার মাটি এখনো সৃজনশীল, স্বাদে-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ।

শংকর ঘোষের প্রত্যাশা, ‘আমার দুই ছেলে এখন আমার সঙ্গে আছে। ওদের সব সময় বলি, জীবনে যত কিছুই হোক, নিজের হাতের কাজকে ছোট মনে করবি না। চাই, একদিন আমার নাতিও বলুক—আমার ঠাকুরদার সন্দেশ মানুষ মনে রেখেছে।’

সর্বশেষ