
এবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষিরশাপাতি, ল্যাংড়া, আম্রপালি, রাঙ্গুয়াই, এমনকি নাগফজলি জাতের আম একসঙ্গে পেকে গেছে। ফলের মৌসুমি বৈচিত্র্য ভেঙে একসঙ্গে সব আম পাকার ঘটনায় আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে। কারণ হিসেবে উঠে এসেছে তীব্র গরম, অতিরিক্ত কীটনাশক ও ফলপাকানো রাসায়নিকের ব্যবহার এবং ঈদ উপলক্ষে দীর্ঘ ছুটিকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাহাড়ে আগেভাগেই পেকে গেছে রাঙ্গুয়াই ও আম্রপালি
খাগড়াছড়িসহ পাহাড়ি অঞ্চলে আগে আম্রপালি ও পরে রাঙ্গুয়াই জাতের আম পাড়া হতো—এটাই ছিল চিরাচরিত নিয়ম। এবার সেই হিসাব মিলছে না। ব্যবসায়ী ও চাষি জ্ঞানজ্যোতি চাকমা জানালেন, এবার রাঙ্গুয়াই আগেভাগেই পেকে গেছে, একইসঙ্গে আম্রপালিও পরিপক্ক হয়ে পড়েছে। এর ফলে বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেলেও দাম পড়েছে হু হু করে। গত বছর যেখানে রাঙ্গুয়াই ২৫ টাকায় বিক্রি হতো, এবার তা নেমে এসেছে ১৬ টাকায়। আম্রপালিও ৪০ টাকার জায়গায় এখন ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
উত্তরের অবস্থাও একই
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও নওগাঁর মতো উত্তরাঞ্চলীয় ‘আমের ভাণ্ডার’ এলাকাতেও একই অবস্থা। এখানে একসঙ্গে পেকে গেছে ক্ষিরশাপাতি, ল্যাংড়া, আম্রপালি এমনকি দেরিতে পাকা ব্যানানা ম্যাংগোও।
তাপপ্রবাহই মূল কারণ
৮ জুন থেকে দেশের ৩৫–৪০টি জেলায় তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়, যা একটানা চার-পাঁচ দিন স্থায়ী হয়। এর আগে মে মাসের শেষদিকে মৌসুমি বৃষ্টিপাত হলেও তা দ্রুতই তাপপ্রবাহে রূপ নেয়। আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদের মতে, এই অস্বাভাবিক তাপ ও বর্ষার অসামঞ্জস্যই ফলের পাকাকে ত্বরান্বিত করেছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এম আবদুর রহিম ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, তাপমাত্রা বাড়লে আমের শ্বাসপ্রশ্বাসের হারও বেড়ে যায়, ফলে তার চিনি উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়ে এবং দ্রুত পেকে যায়। তবে এর ঘ্রাণ ও স্বাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারে দ্রুত পাকে আম
চাষিরা আম বড় ও চকচকে করতে কীটনাশক, বালাইনাশক, রাইপেনারসহ নানা রাসায়নিক ব্যবহার করেন, অনেক সময় সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে আসা ‘টনিক’ প্রয়োগ করেও ফল পাকানো হয়। কৃষি উদ্যোক্তা মঞ্জুরে আলম বলছেন, মাঠপর্যায়ে এসব রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে আম দ্রুত পাকে। কৃষি বিশেষজ্ঞ এম রহিমও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ঈদের দীর্ঘ ছুটিতে বাজারে বিপর্যয়
৭-১০ দিনব্যাপী ঈদের ছুটিতে আম পাড়া ও পরিবহন প্রায় বন্ধ ছিল। ফলে গাছেই আম পেকে গেছে। এখন সব ধরনের আম একসঙ্গে পাড়তে হচ্ছে, বাজারে হঠাৎ আমের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দাম পড়ে গেছে। সাপাহারের আমচাষি সোহেল রানা জানালেন, ঈদের আগে আম্রপালি মণপ্রতি সাড়ে চার হাজার টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা আড়াই হাজারের ওপরে উঠছে না। ল্যাংড়া এক হাজার ২০০–১ হাজার ৫০০ টাকায় নামতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার ঘাটতিও বড় কারণ
উৎপাদনকারী মনজুরে আলম মনে করেন, দেশে আম সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সঠিক অবকাঠামো থাকলে এমন ক্ষতির মুখে পড়তে হতো না চাষিদের।
সার্বিকভাবে একসঙ্গে বিভিন্ন জাতের আম পাকার ঘটনাটি শুধু কৃষকের আয়েই ধস নামায়নি, বাজারে আমের স্বাভাবিক সরবরাহ ও দামের ভারসাম্যও ভেঙে দিয়েছে। এই অবস্থায় নিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক ব্যবহার, সময়মতো সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ অবকাঠামো গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।