
বিনিয়োগ কেবল টাকা ঢালার বিষয় নয়, এটি একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত এবং অর্থনৈতিক জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে যে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী সক্রিয়, তাদের অধিকাংশই মৌলিক বিনিয়োগ শিক্ষা ছাড়াই প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন করছেন। কারও সিদ্ধান্ত আসে গুজব থেকে, কেউ বন্ধুর পরামর্শে, কেউবা ইউটিউব ইনফ্লুয়েন্সারদের লাইভ দেখে শেয়ার কেনাবেচা করেন। ফলাফল— অপেশাদার সিদ্ধান্ত, বিশাল ক্ষতি এবং দীর্ঘমেয়াদে বাজারের প্রতি আস্থা সংকট।
বর্তমানে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে সক্রিয় বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবের সংখ্যা ১৭ লাখের কাছাকাছি। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, এর একটা বড় অংশের বিনিয়োগকারী কখনো PE Ratio বা EPS সম্পর্কেই জ্ঞান রাখেন না, এমনকি ট্রেডিং এবং ইনভেস্টমেন্টের মধ্যে পার্থক্যও বোঝেন না। IPO মানেই লাভ— এই ভুল ধারণায় অনেকে তাদের সঞ্চয় হারিয়েছেন। গুজব নির্ভর Penny Stock-এ বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়েছেন বহু মানুষ। শেয়ারের প্রকৃত মূল্যায়ন না বুঝেই ‘ট্র্যাপ শেয়ার’-এ আটকে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মূলধন অবরুদ্ধ হয়েছে। বাজার পতনের সময় Panic Sell করে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী মূলধন হারিয়েছেন। এই বাস্তব চিত্র আমাদের সামনে একটি স্পষ্ট বার্তা দেয়— বিনিয়োগ শিক্ষা ছাড়া একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজার সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাও এই সত্যের সাক্ষ্য দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে স্কুল জীবন থেকেই অর্থনীতি ও বিনিয়োগ শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (SEC) এবং FINRA এর আওতায় “Investor Education Portal” সক্রিয়ভাবে কাজ করে বিনিয়োগকারীদের প্রশিক্ষণে। ভারতে SEBI “Investor Education and Protection Fund” চালু করেছে, যেখানে বিনিয়োগ শুরু করার আগে নির্দিষ্ট কোর্স ও প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। মালয়েশিয়ায় স্কুল- কলেজ পর্যায়ে বিনিয়োগ শিক্ষা দেওয়া হয় বিভিন্ন Simulation Game-এর মাধ্যমে। এমনকি শ্রীলঙ্কার মতো ছোট অর্থনীতিতেও স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃক সার্টিফিকেট কোর্স চালু রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য।
বাংলাদেশে বিনিয়োগ শিক্ষার ক্ষেত্রটি এখনো অনেকটাই সীমাবদ্ধ। যদিও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ একাডেমি কিছু শিক্ষামূলক কোর্স চালু করেছে, তবে সেগুলোর মূল প্রতিবন্ধকতা হলো— মূল্য,সময়সূচি ও অবস্থান। কোর্সগুলো ঢাকায় DSE ভবনে এবং শুধুমাত্র কর্মদিবসে অনুষ্ঠিত হয়, যা ঢাকার বাইরের কিংবা চাকরিজীবী বিনিয়োগকারীদের পক্ষে অংশগ্রহণ করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। তদুপরি কোর্স ফি তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এতে অংশ নিতে পারেন না। ফলে বিনিয়োগ শিক্ষা এখনো নির্দিষ্ট শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে, যা একটি বড় নীতিগত ব্যর্থতা।
এই বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য কয়েকটি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি। প্রথমতঃ যেকোনো বিনিয়োগকারীকে বিও অ্যাকাউন্ট খোলার আগে একটি সংক্ষিপ্ত বিনিয়োগ শিক্ষা কোর্স সম্পন্ন করে একটি স্বল্পপরিসরের মূল্যায়ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এই কোর্স ও পরীক্ষা অনলাইনে, বাংলায়, বিনামূল্যে এবং মোবাইলফোনে সম্পন্ন করার সুযোগ থাকতে হবে। দ্বিতীয়তঃ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে “অর্থনীতি ও বিনিয়োগ শিক্ষা” বিষয়টি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি Elective হিসেবে চালু করা যেতে পারে। তৃতীয়তঃ পড়াশোনা শেষ করা সাধারণ নাগরিকদের জন্য একটি অ্যাপভিত্তিক শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম চালু করা যেতে পারে, যেখানে অ্যানিমেটেড ভিডিও, কুইজ এবং রিয়েল টাইম মার্কেট ডেমো থাকবে।
যেসব বিনিয়োগকারী সরাসরি শিক্ষা নিতে আগ্রহী নন তাদের জন্য বিকল্প হিসেবে নিবন্ধিত বিনিয়োগ পরামর্শক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এই বিনিয়োগ পরামর্শক BSEC অনুমোদিত ও প্রশিক্ষিত হবেন এবং বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও গঠন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করবেন। একইসাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব ব্যক্তি বিনিয়োগ পরামর্শ দেন, তাদের জন্য লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা জরুরি— না হলে ভুয়া তথ্য ও গুজবের মাধ্যমে ক্ষতির ঝুঁকি বহুগুণে বাড়বে। এছাড়া সরকার প্রতি বছর এক সপ্তাহ ধরে জাতীয় পর্যায়ে বিনিয়োগ শিক্ষা সপ্তাহ চালু করতে পারে, যেমন “Financial Literacy Week” মালয়েশিয়ায় হয়। জেলা- উপজেলা পর্যায়ে মাসিক বিনিয়োগ শিক্ষা ক্যাম্প চালু করলেও সাধারণ মানুষের কাছে জ্ঞানের আলো পৌঁছানো সম্ভব হবে।
অজ্ঞতা হলো বিনিয়োগে ক্ষতির সবচেয়ে বড় কারণ। একটি সচেতন বিনিয়োগকারী মানেই একটি নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং স্থিতিশীল পুঁজিবাজার। আর পুঁজিবাজার হলো দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। তাই, বিনিয়োগ শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা শুধু বিনিয়োগকারীর স্বার্থেই নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের পথনির্দেশক হিসেবেও বিবেচিত হওয়া উচিত। সময় এসেছে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের বাঁচানোর।
লেখক : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক
মতিঝিল, ঢাকা