
হারনেস বেঁধে মাথায় হেলমেট পরিয়ে দিলেন প্রশিক্ষক। ক্লাইম্বিং বা জিপ লাইনে ঝোলার জন্য এ দুটিই অবশ্য করণীয়। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া সহোদর সারাফ হোসেন ও মাহিরা হোসেন রোমাঞ্চকর জিপ লাইনের অভিজ্ঞতা নিতে প্রস্তুত। এবার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে উঁচু টাওয়ারে। মাহিরা একবারে উঠে গেলেও সাহস করল না সারাফ। পাশে দাঁড়ানো মা-বাবাও জোর করলেন না। অ্যাকটিভিটি শেষে মেয়ে কাছে আসতেই বাবা একগাল হেসে বলে উঠলেন, ‘আমি তো ভেবেছি মাহিরাও ভয় পাবে, কিন্তু হলো তো উল্টো।’
এয়ারফোর্স বেজক্যাম্পে হাস্যোজ্জ্বল এ পরিবারের সঙ্গে কথা হয় গত ১৮ জুলাই শুক্রবার। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ও বেজক্যাম্প অ্যাডভেঞ্চারস লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর আগারগাঁওয়ে চালু হয়েছে এই ক্যাম্প।
ইট–সিমেন্টের শহরে সন্তানদের একটু সবুজের স্বাদ দিতেই এখানে এসেছেন শাখাওয়াত হোসেন ও কোরা হাসান দম্পতি। পড়াশোনার পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই সন্তানেরা প্রকৃতি দেখবে, বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত থাকবে, এটাই এই মা-বাবার চাওয়া। প্রথমে একটু ভয় লাগলেও আকাশে ওড়া বেশ উপভোগ করেছেন, জানাল মাহিরা।
র্মশালায় শিশুদের ভিড়
‘কর্মশালা’ শব্দটি শুনলেই কেমন বড়দের ব্যাপার মনে হয় না? তবে বেজক্যাম্পের স্কিল ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কশপে চোখে পড়ল নানা বয়সী শিশুদের ভিড়। লাল, হলুদ, সবুজ; কোন বাতি জ্বললে কী করতে হবে, শেখাচ্ছিলেন প্রশিক্ষক। শিশুরাও মনে রেখে উত্তর দিচ্ছিল প্রশ্নের। পরের কাজ, গোবরের সঙ্গে মাটি মিশিয়ে গাছ রোপণ। গোবর যেহেতু, অনেকেই তাই ইতস্তত করছিল। প্রশিক্ষক জানালেন, এটা তো প্রক্রিয়াজাত গোবর। যখনই এ কথা বলা হলো কার্যক্রম শেষে সবাইকে হাত ধুইয়ে দেওয়া হবে, অনেকেই তখন সাগ্রহে কাজ শুরু করল; অর্থাৎ ময়লা হাত নিয়ে পরের সময়টুকু কাটাতে হবে কি না, এটাই ছিল ভয়।
দুই সপ্তাহ পরপর অনুষ্ঠিত হয় লাইফ স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্মশালা। ফেসবুকে জানানো হয় বিস্তারিত। সে অনুযায়ী করতে হয় নিবন্ধন। বর্তমানে শিশুদের শেখানো হয় ক্যাম্পিং, রান্না, তাঁবু খাটানো, ক্লাইম্বিং, প্রাথমিক চিকিৎসা, কাঠের মিস্ত্রির কাজ, রাস্তায় চলাচলের নিয়ম, বাসায় ব্যবহৃত প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার এবং জৈব সার দিয়ে গাছ লাগানো।
কর্মশালা নিয়ে জানতে চাইলে বেজক্যাম্পের সিনিয়র অপারেশন ম্যানেজার ইসরাত জাহান বলেন, ‘এক দিনেই আমরা অনেক কিছু শিখিয়ে ফেলব, ব্যাপারটা এমন নয়। সবকিছু হয়তো ওরা মনেও রাখতে পারবে না। তাই একদম মৌলিক বিষয়গুলো শেখানো হয়। তবে প্রত্যেকের মধ্যে এসব বিষয়ে আগ্রহ জন্মানোটাই আমাদের উদ্দেশ্য।’
সন্তানকে পুরো কর্মশালাটি করাতে চাইলে একজন অভিভাবককে গুনতে হবে ১ হাজার ২০০ টাকা। এই খরচেই পাওয়া যাবে পুরো কোর্স, দুপুরের খাবার ও সন্ধ্যার নাশতা।
একনজরে বেজক্যাম্প
পছন্দের প্যাকেজ নিয়ে বেজক্যাম্পে ঢোকার পর প্রথমেই গ্যালারিতে বসিয়ে সবাইকে দেওয়া হয় সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা। এরপর সামনের মাঠে চলে ওয়ার্মআপ। বেশি মানুষ হলে একাধিক দল বানিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন কার্যক্রম। প্রথমেই থাকে ‘অন গ্রাউন্ড অ্যাকটিভিটি’। এ পর্যায়ে পেরোতে হয় টায়ার ও রশি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন বাধা।
ক্যাম্পের এক পাশে কয়েকটি গাছকে কেন্দ্র করে বানানো হয়েছে ‘ট্রি টপ অ্যাকটিভিটি’। ঝুলন্ত রশি, টায়ার, কাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে এ কার্যক্রম সমাপ্ত করা বেশ চ্যালেঞ্জিং।
এরপর অংশ নিতে পারেন ক্লাইম্বিং ওয়াল বা জিপ লাইন কার্যক্রমে। এ দুটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়। দ্বিতীয়টা একটু সহজ হলেও প্রথমটা বেশ কষ্টসাধ্য। তিনটি সুযোগে ২৫ মিনিটে শেষ করতে হয় এই অ্যাকটিভিটি। এখানে রয়েছে আর্চারি ও ফুটবল খেলার ব্যবস্থাও। সে ক্ষেত্রে আলাদা করে মাঠ বুকিং দিতে হয়। সবগুলো আয়োজনই শারীরিক ও মানসিক দক্ষতার পরীক্ষা নেবে। তাই দল নিয়ে বা পরিবারের সঙ্গে গেলেই মিলবে বেশি আনন্দ। আর ঢিলেঢালা পোশাক পরলে সুবিধা পাওয়া যাবে।
এ ছাড়া ১২ বছরের নিচের শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা ‘প্লে জোন’। বড়দের কিছু অ্যাকটিভিটি শুধু শিশুদের জন্যই আলাদা করে নকশা করা হয়েছে। তাঁবুতে রাত্রিবাসের ব্যবস্থাও আছে।
একজন প্রশিক্ষক জানান, পর্যটকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রতিটি কার্যক্রমেই সঙ্গে থাকেন দক্ষ প্রশিক্ষক। দেন প্রয়োজনীয় কটি দিকনির্দেশনা। তাই সব কার্যক্রমই নিরাপদ।
ভিন্ন চাহিদা, ভিন্ন প্যাকেজ
দিনের সময় ও বিভিন্ন বয়সীর কথা চিন্তা করে রাখা হয়েছে ভিন্ন ধরনের প্যাকেজ। যেমন সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে শুরু হয় আর্লি মর্নিং প্যাকেজ। পর্যায়ক্রমে মর্নিং, আফটারনুন, ইভিনিং প্যাকেজগুলোতে সংযোজিত আছে নির্দিষ্ট অ্যাকটিভিস্টদের নাম। আবার ‘ফ্যামিলি এসকেপ’ শুধু শিশু ও তার অভিভাবকের জন্য। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আইডি কার্ড দেখিয়ে উপভোগ করতে পারবেন ‘ফ্রেন্ডস হ্যাংআউট’ প্যাকেজটি।
তবে বড় দল হলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে শর্ত সাপেক্ষে নিজেদের মতো করে অ্যাকটিভিটিস সাজিয়ে নেওয়ারও সুযোগ আছে। বর্তমানে নির্ধারিত প্যাকেজে খরচ পড়বে ৯৫০ থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকা। ‘সিঙ্গেল এন্ট্রি’; অর্থাৎ প্রবেশের পর একটি অ্যাকটিভিটি বা খাবার নিলে দাম পড়বে ৪০০ টাকা। শিশুদের জন্মদিন, বিয়ে, করপোরেট অনুষ্ঠানের জন্যও ভেন্যু হিসেবে এই ক্যাম্প ভাড়া নেওয়া যায়। বেজক্যাম্পে ইতিমধ্যে ক্লাইম্বিং ক্লাব চালু হয়েছে।
যেভাবে যাবেন
মেট্রোরেলে এখানে যাওয়া একদম সহজ। আগারগাঁও মেট্রোরেল স্টেশন থেকে বেজক্যাম্প এক মিনিটের পথ। আগারগাঁওয়ের আইডিবি ভবনের উল্টো দিকে বিমানবাহিনী জাদুঘরের পাশেই এর অবস্থান। তথ্য জানতে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৯৪২৭৭৭৯৯৯ বা airforcebasecamp.com এই ঠিকানায়