
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অপারেশন কক্ষের স্ক্রিন গত ৭ মে মধ্যরাতের পরপরই হঠাৎ লাল হয়ে ওঠে। সেখানে জ্বলে ওঠে লাল আলো। এর অর্থ হলো, ভারতের সীমান্তবর্তী আকাশে শত্রুর অনেকগুলো যুদ্ধবিমান ওড়াউড়ি করছে।
কয়েক দিন ধরে সেই অপারেশন কক্ষের পাশে একটি গদিতে ঘুমাচ্ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল জাহির সিদ্দু। কারণ, তাঁর আশঙ্কা ছিল, ভারত যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারে।
নয়াদিল্লি অভিযোগ করে আসছিল, ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে আগের মাসে সংঘটিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ হামলায় ভারতের ২৫ জন ও নেপালের ১ জন পর্যটক নিহত হয়েছিলেন।
ইসলামাবাদ বারবার নয়াদিল্লির অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বে ভারত প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দেয়। ৭ মে ভোরে পাকিস্তানের ওপর বিমান হামলার মাধ্যমে সেই প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে ভারত।
অপারেশন কক্ষের স্ক্রিনে লাল আলো জ্বলে ওঠার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীনের তৈরি পাকিস্তানের মূল্যবান জে-১০সি যুদ্ধবিমান আকাশে ওড়ানোর নির্দেশ দেন সিদ্দু। এ সময় অপারেশন কক্ষে উপস্থিত ছিলেন—পাকিস্তান বিমানবাহিনীর এমন একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, সিদ্দু তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর সেনাদের (স্টাফদের) ভারতের বহরে থাকা সবচেয়ে আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধবিমান রাফালকে নিশানা করার নির্দেশ দেন। ফ্রান্সের তৈরি এই জঙ্গি বিমান এর আগে আর কখনো কোনো যুদ্ধে ভূপাতিত হয়নি।
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর এই কর্মকর্তা বলেন, তিনি (সিদ্দু) কয়েকটি রাফাল বিধ্বস্ত দেখতে চেয়েছিলেন।
সেই রাতের ঘণ্টাব্যাপী আকাশ–লড়াই হয়েছিল ঘোর অন্ধকারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে প্রায় ১১০টি যুদ্ধবিমান অংশ নিয়েছিল। এটি ছিল গত কয়েক দশকে মাঝ আকাশে দুই পক্ষের যুদ্ধবিমানের মধ্যে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স মে মাসে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ভারতের সঙ্গে সংঘাতে চীনের তৈরি পাকিস্তানের জে-১০ যুদ্ধবিমান অন্তত একটি রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের বরাতে এ তথ্য জানানো হয়েছিল।
ফ্রান্সের তৈরি অত্যাধুনিক রাফাল ভূপাতিত হওয়ার খবরে সামরিক বিশ্লেষকদের অনেকে হতবাক হয়েছিলেন। রাফাল ভূপাতিত হওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে পরীক্ষিত নয়, চীনের এমন সামরিক সরঞ্জামের বিপরীতে পশ্চিমা সামরিক সরঞ্জামের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ভূপাতিত হওয়ার খবর প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাফাল নির্মাতা ফরাসি কোম্পানি দাসো এভিয়েশনের শেয়ারমূল্য কমে গিয়েছিল। রাফাল কেনার জন্য ক্রয়াদেশ দেওয়া ইন্দোনেশিয়া জানিয়েছে, তারা এখন চীনের জে-১০ যুদ্ধবিমান কেনার কথা বিবেচনা করছে।
তবে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেছেন—ভারতের এমন দুজন ও পাকিস্তানের তিনজন কর্মকর্তা ভিন্নমত দিয়েছেন। তাঁদের মতে, রাফালের কর্মক্ষমতাই মূল সমস্যা ছিল না; বরং ভারতের গোয়েন্দা–ব্যর্থতাই রাফাল ভূপাতিত হওয়ার প্রধান কারণ।
ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা হলো, তাদের হাতে চীনের তৈরি পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রের রেঞ্জের বিষয়ে সঠিক তথ্য ছিল না। জে-১০ যুদ্ধবিমান থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছিল। চীনের বাইরে একমাত্র পাকিস্তানের কাছেই একই সঙ্গে যুদ্ধবিমান জে-১০ (ভিগোরাস ড্রাগনস) ও পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেন, ভুল গোয়েন্দা তথ্যের কারণে রাফাল পাইলটদের মধ্যে মিথ্যা আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল। ভারতের পাইলটরা ধরে নিয়েছিলেন, তাঁরা পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতের পরিধির বাইরে রয়েছেন। তাঁদের ধারণা ছিল, পাকিস্তানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র সর্বোচ্চ ১৫০ কিলোমিটার দূরের নিশানায় আঘাত হানতে পারে। এটিই পিএল-১৫–এর সর্বোচ্চ পাল্লা বলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত।
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ওত পেতে ছিলাম।’ ভারতের পাইলটদের বিভ্রান্ত করতে দিল্লির প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর ইসলামাবাদ বৈদ্যুতিক যুদ্ধ (ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার) চালিয়েছিল বলেও জানান তিনি। কিন্তু ভারতীয় কর্মকর্তারা পাকিস্তানের বৈদ্যুতিক যুদ্ধের কার্যকারিতা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন।
বৈদ্যুতিক যুদ্ধ হলো এমন একধরনের সামরিক কৌশল, যেখানে শত্রুর রাডার, যোগাযোগ ও সেন্সর সিস্টেমকে বিভ্রান্ত বা বিকল করার জন্য বৈদ্যুতিক সংকেত ব্যবহার করা হয়।
লন্ডনের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) বিমানযুদ্ধ বিশ্লেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক বলেন, ‘ভারতীয়রা ভাবতেই পারেননি যে তাঁদের (যুদ্ধবিমান) লক্ষ্য করে গুলি করা (ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া) হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র যে দীর্ঘপাল্লায় অত্যন্ত কার্যকর, তা স্পষ্ট।’
পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের মতে, রাফালকে আঘাত করা পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রায় ২০০ কিলোমিটার (প্রায় ১২৪ মাইল) দূর থেকে ছোড়া হয়েছিল। ভারতীয় কর্মকর্তাদের মতে, দূরত্বটা আরও বেশি হতে পারে। এত দূর থেকে রাফাল ভূপাতিত করার বিষয়টি সত্য হলে আকাশ থেকে আকাশে দীর্ঘতম পাল্লায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার এটাই বিশ্ব রেকর্ড।
ভারতের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গোয়েন্দা ত্রুটি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। তা ছাড়া নয়াদিল্লি এখন পর্যন্ত কোনো রাফাল ভূপাতিত হওয়ার কথা স্বীকার করেনি। তবে ফ্রান্সের বিমানবাহিনীর প্রধান গত জুনে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি একটি রাফাল এবং ভারতের পরিচালিত আরও দুটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন। শেষের দুই যুদ্ধবিমানের একটি রাশিয়ার তৈরি সুখোই।
ওই মাসেই দাসো এভিয়েশনের একজন শীর্ষ নির্বাহী ফরাসি আইনপ্রণেতাদের বলেছিলেন, সংঘাতে ভারত একটি রাফাল হারিয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বিস্তারিত কিছু বলেননি।
ভারতের রাফাল ভূপাতিত করার বিষয়ে জানতে চাইলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেদের এক মুখপাত্রের আগের এক বক্তব্যের প্রসঙ্গ টানে। ওই মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘অস্ত্র নয়, পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের পেশাদার প্রস্তুতি ও দৃঢ় সংকল্পই ছিল মূল বিষয়।’
মন্তব্যের জন্য চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো জবাব পায়নি রয়টার্স। রাফাল নির্মাতা দাসো ও সুখোই নির্মাতা রাশিয়ার ইউএসি-ও রয়টার্সের কাছে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ভারতের রাফাল ভূপাতিত করার বিষয়ে জানতে চাইলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিজেদের এক মুখপাত্রের আগের এক বক্তব্যের প্রসঙ্গ টানে। ওই মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘অস্ত্র নয়, পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের পেশাদার প্রস্তুতি ও দৃঢ় সংকল্পই ছিল মূল বিষয়।’
মন্তব্যের জন্য চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো জবাব পায়নি রয়টার্স। রাফাল নির্মাতা দাসো ও সুখোই নির্মাতা রাশিয়ার ইউএসি-ও রয়টার্সের কাছে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
পরিস্থিতি বোঝার সক্ষমতা’
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে মে মাসের যুদ্ধ চার দিন স্থায়ী হয়েছিল। পারমাণবিক শক্তিধর এ দুই প্রতিবেশীর পাল্টাপাল্টি বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা ওয়াশিংটনকে শঙ্কিত করেছিল। সংঘাতের বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পাকিস্তানের আটজন ও ভারতের দুজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় হওয়ায় এসব কর্মকর্তার সবাই নাম গোপন রাখতে অনুরোধ করেছেন।
পাকিস্তানের পাশাপাশি ভারতের কর্মকর্তারাও বলেছেন, ইসলামাবাদ যে শুধু ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা (রেঞ্জ) দিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তা নয়; পাকিস্তান আরও বেশি দক্ষতার সঙ্গে নিজেদের সামরিক সরঞ্জামকে স্থল ও আকাশের নজরদারিব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছিল। ফলে দেশটির কাছে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক বেশি পরিষ্কার ধারণা ছিল।
এই নেটওয়ার্ক বা রণক্ষেত্রে সামরিক সরঞ্জামকে স্থল ও আকাশের নজরদারিব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করাকে ‘কিল চেইন’ বলা হয়, যা আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানের চারজন কর্মকর্তা বলেন, তাঁরা একটি ‘কিল চেইন’ বা মাল্টিডোমেইন (বহুমাত্রিক) অপারেশন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। এর মাধ্যমে আকাশ, স্থল ও মহাকাশে থাকা নজরদারি সেন্সরগুলোকে একসঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল।
পাকিস্তানের দুজন কর্মকর্তা আরও বলেন, এই নেটওয়ার্কে পাকিস্তানের তৈরি ‘ডেটা লিংক ১৭’ নামের একটি সিস্টেমও যুক্ত করা হয়েছিল। এটির মাধ্যমে চীনা সামরিক সরঞ্জামের সঙ্গে সুইডেনের তৈরি নজরদারি বিমানসহ অন্য যন্ত্রপাতিকেও সংযুক্ত করা হয়েছিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই সিস্টেমের মাধ্যমে ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে উড়তে থাকা পাকিস্তানের জে-১০ যুদ্ধবিমানগুলো দূরবর্তী নজরদারি বিমানের রাডারের তথ্য পেতে সক্ষম হয়। ফলে চীনের তৈরি এই যুদ্ধবিমানগুলো নিজেদের রাডার বন্ধ রেখেই উড়তে পেরেছিল। এর অর্থ হলো, তারা শত্রুর নজরদারির বাইরে থেকে গোপনে আক্রমণ চালাতে পেরেছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ভারতের কর্মকর্তারা জানান, নয়াদিল্লিও এমন একটি সমন্বিত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল। কারণ, ভারত অনেক বেশি ভিন্ন ভিন্ন দেশের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান কিনেছে। ফলে তথ্য ও প্রযুক্তিকে একীভূত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাজ্যের সাবেক এয়ার মার্শাল ও রুসির ফেলো গ্রেগ ব্যাগওয়েল বলেন, এ ঘটনার মাধ্যমে চীনা কিংবা পশ্চিমা সামরিক সরঞ্জামের শ্রেষ্ঠত্ব চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়নি; বরং সঠিক তথ্য থাকা ও তা ব্যবহার করার গুরুত্ব প্রমাণিত হয়েছে।
গ্রেগ ব্যাগওয়েল আরও বলেন, ‘যার পরিস্থিতি বোঝার সক্ষমতা বা সিচুয়েশনাল অ্যাওয়ারনেস সবচেয়ে ভালো ছিল, সে পক্ষই এ যুদ্ধে জিতেছে।’