
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যে ব্যাপক হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করায় দেশটির অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেতে যাচ্ছে। এর স্পষ্ট প্রভাব পড়ছে পোশাক খাতে। উচ্চ শুল্কের কারণে ইতোমধ্যে বিদেশি কোম্পানিগুলো ভারতের পণ্যের ক্রয়াদেশ বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। অ্যামাজন-ওয়ালমার্টের মতো কোম্পানি ভারত থেকে পোশাক আমদানি স্থগিত করেছে। এর সুফল পেতে পারে বাংলাদেশ। পার্ল গ্লোবালের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় কারখানা স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছে।
শুল্ক আরোপকে কেন্দ্র করে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা এখন চরমে। বলা হচ্ছে, গত কয়েক দশকের মধ্যে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক এখন সবচেয়ে তলানিতে। ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, তারা শুল্ক নিয়ে ভারতের সঙ্গে আপাতত কোনো আলোচনা বসবে না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে ভারত। সেই সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের ওয়াশিংটন সফরও বাতিল করা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে পুরোনো মিত্র রাশিয়ার দিকেই এগোচ্ছে ভারত। দেশটির প্রতিরক্ষা সচিব অজিত দোভাল মস্কোয় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, সেখান থেকে দোভাল জানিয়েছেন– প্রেসিডেন্ট পুতিন কবে ভারত সফর করবেন, তা ‘প্রায় নিশ্চিত’ হয়েছে।
সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দুই দফায় ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে কার্যত ছিটকে পড়ে ভারত। পোশাক ও স্বর্ণালংকার খাত বড় ধাক্কা খায়। আগামী ২৭ আগস্টের মধ্যে তাদের সমঝোতার সুযোগ রয়েছে। তবে সম্পর্ক তিক্ততার দিকে যাওয়ায় ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, তারা ভারতের সঙ্গে এ নিয়ে আপাতত আর কোনো আলোচনা করবে না।
তবে ইসরায়েলের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছে মোদি প্রশাসন। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, গত বৃহস্পতিবার এক দল ভারতীয় সাংবাদিক নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ট্রাম্পের সঙ্গে কীভাবে চুক্তি করতে হয়, সেটা তিনি মোদিকে বলে দেবেন। এটা ‘গোপনে’ করা হবে বলেও জানান তিনি। নেতানিয়াহু জানান, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন সিন্দুর’-এ ইসরায়েলের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
রয়টার্স জানায়, ভারতের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পর পোশাক প্রস্তুতকারক কোম্পানি পার্ল গ্লোবাল ভারতে পণ্য উৎপাদন সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। কোম্পানিটির গ্রাহকদের মধ্যে গ্যাপ ও কোহলস অন্তর্ভুক্ত। পার্ল গ্লোবাল ভারতীয় আমদানির ওপর মার্কিন অতিরিক্ত শুল্ক এড়িয়ে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও গুয়াতেমালায় তার ১৭টি কারখানায় উৎপাদন স্থানান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে। পার্ল গ্লোবাল লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পল্লব ব্যানার্জি এক সাক্ষাৎকারে রয়টার্সকে বলেন, ‘সব গ্রাহক ইতোমধ্যে আমাকে ফোন করছেন। তারা চান, আমরা ভারত থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হই।’
বর্তমানে ভারত ৫০ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হলেও বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ এবং চীন ৩০ শতাংশ মার্কিন শুল্কের মুখোমুখি হচ্ছে। ভারতের পোশাক খাত ইতোমধ্যে শ্রমিক সংকটে রয়েছে। কিন্তু রপ্তানিকারকদের ভারতের বাইরে উৎপাদন স্থানান্তরের কারণে নরেন্দ্র মোদির ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নীতি বড় ধাক্কা খাবে। শুধু পার্ল গ্লোবালই নয়, অন্য পোশাক প্রস্তুতকারক কেম্পানিগুলোও একইভাবে ভাবছে। ভারতের রিচাকো এক্সপোর্টস এ বছর যুক্তরাষ্ট্রে ১১১ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করে। ভারতজুড়ে তাদের দুই ডজনেরও বেশি কারখানা রয়েছে।
শুধু পোশাক খাত নয়; ভারতের অন্যান্য রপ্তানি খাতও বড় ক্ষতির শঙ্কায় পড়েছে। দেশটির বৃহত্তম জুয়েলারি ও ঘড়ি প্রস্তুতকারক টাইটান জানিয়েছে, তারা মার্কিন বাজারে কম শুল্কের সুযোগ বজায় রাখতে কিছু উৎপাদন মধ্যপ্রাচ্যে স্থানান্তরের কথা ভাবছে। শীর্ষ ভারতীয় পোশাক প্রস্তুতকারক রেমন্ডের আর্থিক প্রধান অমিত আগরওয়াল বলেন, তিনি ইথিওপিয়ায় কোম্পানির একটি কারখানার ওপর আশাবাদী, যা মাত্র ১০ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি।
ভারতের পণ্য নেবে না অ্যামাজন-ওয়ালমার্ট
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্রের ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজন, ওয়ালমার্ট, টার্গেট, গ্যাপসহ বড় বড় মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ভারত থেকে ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে। ভারতীয় রপ্তানিকারকরা বলছেন, মার্কিন ক্রেতারা ই-মেইল ও চিঠির মাধ্যমে পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্যের চালান আপাতত বন্ধ রাখতে বলেছেন। শুল্ক আরোপের কারণে ক্রেতারা বাড়তি খরচ ভাগাভাগি করতে অস্বীকৃতি জানানোয় ভারতীয় রপ্তানিকারকরাই এ বোঝা বহন করতে বলেছেন।
ট্রাম্পের আরোপ করা দ্বিগুণ শুল্কের জেরে যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পণ্যের রপ্তানি খরচ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্রগামী ক্রয়াদেশ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে যেতে পারে। ফলে ভারতের ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ওয়েলস্পান লিভিং, গোকুলদাস এক্সপোর্টস, ইন্ডো কাউন্ট ও ট্রাইডেন্টের মতো ভারতীয় বড় বড় রপ্তানিকারকের পণ্য বিক্রির ৪০ থেকে ৭০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক। এ ছাড়া ভারতের পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্পে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বড় রপ্তানির বাজার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট ৩৬ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির ২৮ শতাংশই গেছে যুক্তরাষ্ট্রে।
ভারতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দেশে পোশাকের এসব ক্রয়াদেশ চলে যেতে পারে। ভারতের গোকুল এক্সপোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিষদ এনডিটিভি প্রোফিটকে জানায়, বিভিন্ন ব্র্যান্ড অন্য দেশ থেকে উৎপাদন ও কম শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক পণ্য পাঠানোর বিষয়ে ভাবছে।
জুনে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ৪৪% বেশি রপ্তানি
গত ২০ এপ্রিল লিবারেশন ডে ঘোষণা করে যে শুল্ক আরোপ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তার প্রভাবে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। ফাইবার টু ফ্যাশনের এক প্রতিবেদন জানায়, গত জুন মাসের হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে টেক্সটাইল ও অ্যাপারেল (টিঅ্যান্ডএ) রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। ভিয়েতনামের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ।
গুন্ডাকে ছাড় দিলে মাথায় ওঠে : চীনের রাষ্ট্রদূত
এনডিটিভি জানায়, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্টের দেওয়া শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কটাক্ষ করেছেন নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত সু ফেইহং। গত বৃহস্পতিবার এক্সে দেওয়া পোস্টে তিনি লিখেছেন, গুন্ডাকে এক ইঞ্চি ছাড় দাও, সে এক মাইল নিয়ে নেবে। ট্রাম্পকে কটাক্ষ করে মন্তব্যের সঙ্গে পোস্টে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-র একটি মন্তব্যও জুড়ে দিয়েছেন তিনি।