বড় ঋণ কেলেঙ্কারি ও বিপুল আমানত উত্তোলনের ধাক্কা সামলে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে তিন বেসরকারি ব্যাংক—ইউসিবি, আইএফআইসি ও ইসলামী ব্যাংক। বোর্ড পরিবর্তন ও আগের প্রভাবশালী নিয়ন্ত্রকদের শেয়ার বাজেয়াপ্ত করার পর ব্যাংকগুলোতে আবারও আমানতকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। ২০২৫ সালের প্রথম ১০ মাসেই তিন ব্যাংক দ্বিগুণ অঙ্কের আমানত প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।
তবে আমানত ফিরে এলেও মূলধন ঘাটতি এতটাই গভীর যে ব্যবসা সম্প্রসারণে তারা পিছিয়ে রয়েছে। নতুন আমানত থেকেও আয়ের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে।
বোর্ড বদলের পর বদলে যাওয়া চিত্র
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্নীতি ও ঋণ অনিয়মের অভিযোগে তিন ব্যাংকের আগের বোর্ড ভেঙে দেয়।
ইউসিবি মুক্ত হয় সাবেক ভূমিমন্ত্রীর পরিবারের নিয়ন্ত্রণ থেকে,
ইসলামী ব্যাংক মুক্ত হয় এস আলম গ্রুপের প্রভাব থেকে,
আইএফআইসি মুক্ত হয় প্রভাবশালী উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণ থেকে।
এরপর থেকেই নতুন বোর্ড পুনর্গঠন শুরু করে, যা আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে।
মূলধন সংকট: আগানোর পথে বড় বাধা
তিন ব্যাংকই এখন রাইট শেয়ার, সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ও কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের আনার মাধ্যমে মূলধন বাড়ানোর পরিকল্পনায় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ফরবিয়ারেন্স সুবিধা দিলেও প্রভিশন ঘাটতি রয়ে গেছে। মূলধন অনুমোদনে বিএসইসির সহযোগিতা এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সাবেক ডেপুটি গভর্নর রুমি আলীর মতে, এই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে শেয়ার ইস্যুর কিছু শর্ত শিথিল করাই ব্যাংক পুনর্গঠনে সহায়ক হতে পারে।
ইউসিবি: আমানত বাড়লেও মূলধনই প্রধান চ্যালেঞ্জ
২০২৫ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরে ইউসিবি ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি নতুন আমানত পায়—যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা, যার ৫৬% এসেছে রিটেইল গ্রাহকদের থেকে।
নিয়মনীতি—সিআরআর, এসএলআর, এডিআর—সবই পূরণ করছে ব্যাংকটি। তবে মূলধন ঘাটতির কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণে বাধা রয়ে গেছে। সিআরএআর মাত্র ৭.৬৯%, যেখানে ন্যূনতম দরকার ১০%।
ব্যাংকটি এখন রাইট শেয়ার, বন্ড ও নতুন বিনিয়োগকারী আনার চেষ্টা করছে, তবে বিএসইসিতে ফাইল ঝুলে আছে আগের অসামঞ্জস্যতার কারণে। ইউসিবির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন—মূলধন না বাড়াতে পারলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে।
ইসলামী ব্যাংক: রেমিট্যান্সে শীর্ষে ফিরলেও মূলধন কমে ৭ শতাংশ
এস আলম গ্রুপ–সংশ্লিষ্ট দুর্নীতির পর বড় ধরনের আমানত প্রত্যাহার হলেও নতুন বোর্ড দায়িত্ব নেওয়ার পর আবার আমানত বাড়তে থাকে। ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা, যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
রেমিট্যান্স প্রবাহ ২০% বেড়ে ব্যাংকের তারল্য শক্ত করেছে। তবে দীর্ঘদিনের গোপন খেলাপি ঋণের কারণে মূলধন সিআরএআর নেমে এসেছে মাত্র ৭%। বিশাল প্রভিশন ঘাটতির জন্য ব্যাংক ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরবিয়ারেন্স সুবিধা পেয়েছে।
ব্যাংক এখন নতুন বিনিয়োগকারী নিতে চায়, তবে এস আলম গ্রুপের ৮২% শেয়ার আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকায় শেয়ার ইস্যু আটকে আছে।
আইএফআইসি: আমানত ফেরত, তবে সরকারি সহায়তার অপেক্ষা
২০২৪ সালের জুলাইয়ের পর তিন মাসে বড় ধসের মুখোমুখি হওয়া আইএফআইসি গত এক বছরে আবার ৬ হাজার কোটি টাকা নতুন আমানত সংগ্রহ করে। ঋণ বিতরণও এপ্রিল ২০২৫ থেকে নিয়মিত শুরু হয়েছে।
তবে ১৭ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন সংকট তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে বাধা দিচ্ছে। যেহেতু সরকারের শেয়ার ৩০%–এর বেশি, ব্যাংকটি সরকারি মূলধন সহায়তা পাওয়ার আশা করছে।
আইএফআইসি এখন এসএমই খাতে ঋণ এবং ১,২০০টি উপশাখার বিশাল নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ জোরদারের পরিকল্পনা করেছে।
সারাংশ
তিন ব্যাংকই আমানতকারীদের হারানো আস্থা ফিরে পেয়েছে—যা বড় সাফল্য।
কিন্তু নতুন চিত্র একই:
মূলধন ঘাটতি না পূরণ হলে ব্যবসা সম্প্রসারণ সম্ভব নয়, এবং পুনর্গঠনের গতি আটকে যাবে।
চূড়ান্তভাবে ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে—
বিএসইসির অনুমোদন
কৌশলগত বিনিয়োগকারী আনতে সক্ষমতা
এবং কয়েক বছরের ধারাবাহিক আর্থিক শৃঙ্খলার ওপর।
























