
সাগর বেষ্টিত কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেষখালীর মিষ্টি পানের সুখ্যাতি আছে দেশ জুড়ে। লবনাক্ত প্রবন উর্বর এখানকার পাহাড়ী ঢালুতে উৎপন্ন হয় এই মিষ্টি পান। বর্তমানে এই পান চাষীরা আছে নানা দুঃখ-দূর্দশায়। পান চাষ করতে গিয়ে অর্থ সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত তারা। বর্তমানে পান চাষ করতে গিয়ে উৎপাদন খরচ আর বিক্রি কুলিয়ে উঠতে পারছে না। এখানকার উৎপাদিত পানের দাম কমে যাওয়া প্রতিনিয়ত হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের।
বলা হয়ে থাকে মহেশখালীর পানে সোনাফলে। এই মিষ্টি পান স্থানীয় ও দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে স্থান দখল করে আছ। তবে এখানকার এই মিষ্টি পান এখন এক প্রকার সোনার হরিণ। কিছু দিন আগেও পান চাষিরা এক ঝুঁড়ি পান বিক্রি করে মূল্য পেতেন লাখ টাকারও বেশি। তাই পান চাষে জড়িয়ে পড়েছেন বিভিন্ন পেশার লোকজন। তবে সে পানের দামে ধস নেমে এখন তলানীতে পৌছেছে। আগের মত এক ঝুঁড়ি পানে লাখ টাকা পায় না চাষীরা।
জানা যায়, একদিকে বর্ষা মৌসুমে ঝড় বৃষ্টি, অন্যদিকে মূল্যহ্রাস। ফলে ইতিহাসের ভয়াবহতম ধস পড়েছে মহেশখালীর মিষ্টি পানে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে যে পান বিরা প্রতি বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকায়, সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। উৎপাদন খরচ না উঠায় চাষিরা পড়েছেন চরম লোকসানে। মৌসুমের মাঝপথেই অনেক চাষি বরজ তুলে নিচ্ছেন, কেউ কেউ পান ফেলে দিচ্ছেন ক্ষেতেই। তাদের সংসার চালানো তো দূরের কথা, ধারদেনা করে বিনিয়োগ করা অর্থও উঠছে না বলে জানালেন অনেক চাষী। বহু চাষির পরিবার অর্ধাহারে, অনাহারে চলছে। সন্তানদের পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দ্বীপের এই ঐতিহ্যবাহী কৃষিজ অর্থনীতি এখন ধসে পড়ার পথে।
সরজমিন ঘুরে দেখা যায়- উপজেলার হোয়ানক, কালারমারছড়া, বড় মহেশখালী ও শাপলাপুর ইউনিয়নের সমতল জমিতে এবার মৌসুমী পান চাষে নতুন বিপ্লব ঘটিয়েছেন কৃষকরা। গত বছরের ভালো দামের আশায় প্রায় ১৪শ হেক্টর জমিতে ৮ হাজারের বেশি পান বরজ গড়ে তুলেছেন অন্তত ১৩ হাজার চাষি। তাদের প্রত্যেকেই চাষ করেছেন ধারদেনা করে। বরজে বাঁশ, পলিথিন, চারা, সার ও শ্রমিকের ব্যয় মিলে প্রতি বরজে গড়ে খরচ হয়েছে ৭০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা। এখন বাজারে প্রতি বিরা পানের দাম যেখানে ২০০-২৫০ টাকা, সেখানে উৎপাদন খরচ তোলা দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। চাষিরা পড়েছেন মারাত্মক দুশ্চিন্তায়।
মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাইকার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে চাষিদের হাতে পৌঁছাচ্ছে নামমাত্র অর্থ। বাজারে পানের চাহিদা না থাকায় অনেকেই বরজে জমে থাকা পানের গাছ কাটতে বাধ্য হচ্ছেন। কেউ কেউ আবার বিক্রির পরিবর্তে পানের গাছ গরুকে খাওয়াচ্ছেন। ফলে চাষিরা আর্থিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। কয়েকজন চাষির মতে, যদি দ্রুত সরকারের হস্তক্ষেপ না আসে, তবে আগামী মৌসুমে কেউ আর পান চাষে আগ্রহী হবেন না। লোকসান গুনে চাষি পরিবারগুলো খাদ্য সংকটে পড়েছে। ভেঙে পড়ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে থাকা কৃষিজ সংস্কৃতি।
চাষিদের অভিযোগ, উৎপাদন ব্যয় বাড়লেও বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। দালালচক্র ও কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে প্রকৃত উৎপাদক ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। অনেক সময় পরিবহন সংকট, পর্যাপ্ত সংরক্ষণ সুবিধার অভাব এবং ন্যয্যমূল্যে বিক্রির সুযোগ না থাকায় চাষিরা নিরুপায় হয়ে পড়েন। ফলে তারা বাধ্য হচ্ছেন লোকসান গুনে পান বিক্রি করতে অথবা মাঠেই ফেলে দিতে। এই বাস্তবতা পানের মৌসুমে চাষিদের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিনিয়ত লোকসান গুনেও অনেকে বেঁচে থাকার সংগ্রামে পানের মাঠ আঁকড়ে ধরছেন। আবার চকরিয়ার হারবাং, কাকারা, লোহাগড়ার চুনতি ও লামার ফাইতং ও আজিজ নগরের পাহাড়ে পান চাষ হওয়াতে পাইকাররা মহেষখালী দিকে এখন আর আসেনা।
মহেশখালী উপজেলা পান চাষি সমবায় সমিতির সভাপতি শাহ আলম এ প্রতিবেদককে বলেন, 'মহেশখালীর মিষ্টি পান শুধু এই দ্বীপে নয়, সারা বাংলাদেশে অতিথি আপ্যায়নের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। অথচ সেই পান চাষিরা আজ দিশেহারা। এবারে চাষের বিস্তৃতি ছিল নজিরবিহীন, কিন্তু বাজারে এমন ধস নামবে তা কল্পনাও করিনি।’
তিনি বলেন, 'সরকার যদি চাষিদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে, তাহলে কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব। তা না হলে চাষিরা উৎসাহ হারাবেন।
মহেশখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, পানের ফলন ভালো হয়েছে। শুরুতে দামও ছিল। হয়তো আবারও পানের ভালো দাম পাবে চাষিরা।